পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (প্রথম খণ্ড).pdf/১৩৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ প্রথম খণ্ড
১১০

 মালব, কর্ণাট প্রভৃতি দেশের নামের ন্যায় এই বঙ্গাল দেশও সঙ্গীত শাস্ত্রের এক বিশেষ রাগের নামকরণ করেছে। ভুসুক একটি চর্য্যাগীতি এই বঙ্গাল রাগে রচনা করেছেন।

 পূর্ববঙ্গের শ্রেষ্ঠ গৌরব এই যে, এই দেশ থেকেই বাংলা সাহিত্য এবং নাথপন্থের উৎপত্তি হয়েছে। মৎস্যেন্দ্রনাথ যেমন বাংলার আদিম লেখক, তেমনি তিনি নাথপন্থের প্রবর্তক। তাঁর নিবাস ছিল ক্ষীরোদ সাগরের তীরে চন্দ্রদ্বীপে, বর্ত্তমানে সম্ভবতঃ যাকে সনদ্বীপ বলে। ৬৫৭ খ্রীঃ অব্দে তিনি রাজা নরেন্দ্র দেবের রাজত্বকালে নেপালে উপস্থিত হন। তাঁর একটি কবিতা তাঁর পরদর্শন থেকে আশ্চর্যচর্য্যাচয়ের টীকায় উদ্ধৃত হয়েছে।

“কহস্তি গুরু, পরমার্থের বাট
কর্ম্মক রঙ্গ সমাধিক পাট।
কমল বিকসিল কহিহ ণ জমরা
কমল মধু পিবিবি ধোকই ন ভমরা।”

অর্থ-কহনে গুরু পরমার্থের বাট।
কর্ম্মের রঙ্গ সমাধির পাট॥
কমল বিকসিল কহিওনা জোংড়াকে (শাযুককে)।
কমল মধু পান করিতে ভুল করে না ভোমরা।

 এর শেষ দুই পদের সঙ্গে তুলনা করুন

“গুণিনি গুণজ্ঞো রমতে নাগুণশীলস্য গুণিনি পরিতোষঃ।
অলিরেতি বনাৎ কমলং নহি ভেকেতৃেকবাসোহপি।”

(হিতোপদেশ)

 মৎস্যেন্দ্রনাথের পদাঙ্ক অনুসরণ করে কানু পা, কুকুরীপা, ডোম্বী, সরহ, শবরী প্রভৃতি বহু সিদ্ধাচার্য্য চর্য্যাগীতি বা পারমার্থিক গান রচনা করেন। তার কতকগুলি আমরা পেয়েছি। এই গানগুলির একটি বিশেষত্বপদের শেষে ভণিতা। যেমন ধরুন

“সরহ গুণন্তি বর সূন গোহালী কি মো দুঠ বলদে
একেলে জগা নাসিআ রে বিহরহু সুচ্ছন্দে॥”

-সরহ ভণেণ বরং শূন্য গোয়াল, কি মোর দুষ্ট বলদে।
একেলা জগৎ নাশিয়া রে আমি বিহার করি স্বচ্ছন্দে॥

 এই ভণিতার রীতি প্রাচীন বাংলা থেকে সংস্কৃতে যায়। যেমন জয়দেবের গীতগোবিন্দে। সমস্ত মহাজন পদাবলী চর্য্যাগীতির বৈঞ্চব সংস্করণ। নাথপন্থের বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে চর্য্যাগীতির রীতি পঞ্জাব পর্য্যন্ত উত্তর ভারতের পারমার্থিক গানে চলতে তাকে। পঞ্জাব থেকে এই রীতি পারস্যে যায়। পারসী গজল আরবীর অনুকরণে নয়। তা চর্য্যাগীতিরই অনুকরণে। আরবীতে রুসাদী আছে গযল নেই।

 ত্রিপুরার মেহেরকুলের রাজা গোপীচন্দ্র গুরু জালন্ধরী পার নিকট নাথপন্থে দীক্ষিত হয়ে বৈরাগী হয়ে যান। নাথপন্থের সঙ্গে সঙ্গে এই আখ্যান ভারতময় বিভিন্ন ভাষার কবিতার উপজীব্য হয়ে ওঠে। সুদূর হিমালয়ের কাংড়া উপত্যকায় যে গোপীচাঁদের গান প্রচলিত আছে, আমি তার প্রথম চার চরণ উদ্ধৃতি করছি-