পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (প্রথম খণ্ড).pdf/১৩৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ প্রথম খণ্ড
১১৪

তাহাতে চক্ষু জুড়াইয়া গিয়াছিল।” এ পর্যন্ত কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ৪৫টি পল্লীগাথা প্রকাশ করেছেন। এর মধ্যে ২৩টি মুসলমান কবির রচিত।

 গত ব্রিটিশ যুগের ও বর্ত্তমানের সাহিত্য সাধনার কথা সকলের সুবিদিত। সুতরাং এখানে বলা নিম্প্রয়োজন। আমাদের প্রয়োজন আছে আদিকাল থেকে আধুনিককাল পর্যন্ত বাংলার মুসলমানের সাহিত্য সাধনার বিস্তৃত ইতিহাস লেখা এবং প্রাচীন মুসলিম লেখকদের গ্রন্থ প্রকাশ করা। আমাদের সাহিত্যিক বন্ধুরা কি এ দিকে অবহিত এবং অগ্রসর হবেন? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এবং সরকারের অবশ্য কর্ত্তব্য পূর্ববাংলার সকল স্থান থেকে পুঁথি, পল্লীগীতি, পল্লীকাব্য ও উপকথা সংগ্রহ করে রক্ষা করা। বিশ্ববিদ্যালয়ের পুথিবিভাগকে আর সমৃদ্ধ করতে হবে। মোটকথা আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে পূর্ব্ববঙ্গের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়রূপে দেখতে চাই, সরকারী নওকরখানারূপে নয়। এখানে আমি অষ্টাদশ শতাব্দীর কবি “নুরনামার” লেখক নোয়াখালির সন্দ্বীপ নিবাসী আবদুল হাকিমের একটি কথা আমাদের দেশের একশ্রেণীর লোককে শুনিয়ে রাখছি-

“যে সবে বঙ্গেতে জনি হিংসে বঙ্গবাণী।
সে সবার কিবা রীতি নির্ণয় না জানি।।
মাতা পিতামহ ক্রমে বঙ্গেতে বসতি।
দেশীভাষা উপদেশ মনে হিত অতি।
দেশীভাষা বিদ্যা যার মনে না জুরায়।
নিজ দেশ তেয়াগি কেন বিদেশে না যায়।

 যেমন আমরা বাংলার হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খৃষ্টান এক মিশ্রিত জাতি, আমাদের ভাষা বাংলাও তেমনি এক মিশ্রিত ভাষা। বাংলার উৎপত্তি গৌড় অপভ্রংশ থেকে। সংস্কৃতের সঙ্গে তার সম্পর্কটা অতিদূরের। তবুও যেমন কেউ বড় মানুষের সঙ্গে একটা সম্পর্ক আবিস্কার বা উদ্ভাবন করেন আত্মগৌরবের জন্য, তা তিনি মেসো মশায়ের খুড়তুত বোনের মামাশ্বশুরের পিসতুত ভাই হোন না কেন, সেই রকমই আমরা বাংলার সঙ্গে সংস্কৃতের কুটুম্বিতা পাতাই। কথাটা কিছু অতিরঞ্জিত হ’ল বটে। বিশেষ করে সংস্কৃতের ঋণ বাংলা ভাষার আপাদমস্তক এমন ভারাক্রান্ত করেছে যে, সম্পর্কটা স্বীকার না করেই অনেকে পারেন না। ভাষাতত্ত্বামোদীদের জন্য একটা উদাহরণ দেই- “তোমরা ঐ গাছটা দেখ”। এর গৌড় অপভ্রংশ হবে “তুমহেলোআ ওহি গচ্ছং দেকখহ”; এর সংস্কৃত হচ্ছে “যুয়ং অমুং বৃক্ষং পশ্যত।” যুয়ং- তোমার, অমুং- ঐ, বৃক্ষং- গাছ, পশ্যত- দেখ, -বাংলার কোন শব্দই সংস্কৃত থেকে আসেনি। তবে বাংলার গোড়ায় যে আর্যভাষা, তা কেউ অস্বীকার করতে পারেন না।

 সেই আর্য্যভাষার সঙ্গে মিশেছে আদি যুগে কোল, মধ্যযুগে পারসী ও পারসীর ভিতর দিয়ে কিছু আরবী ও যৎসামান্য তুর্কি এবং পরবর্তী যুগে পর্তুগীজ আর ইংরেজি। দু’চারটা দ্রাবিড়, মোঙ্গলীয়, ফরাসী, ওলন্দাজ প্রভৃতি ভাষার শব্দও বাংলায় আছে। মিশ্রভাষা বলে আমাদের কিছু লজ্জা নেই। পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা চলতি ভাষা ইংরেজির প্রায় দশ আনা শব্দসমষ্টি বিদেশী। পশ্চিমবঙ্গের পরিভাষা-নির্ম্মাণ-সমিতি খাঁটি সংস্কৃতভাষার পরিভাষা রচনা করেছেন। পাঠ্যপুস্তকে এরূপ খাঁটি আর্যভাষা চলতে পারে; কিন্তু ভাষায় চলে না। বহুদিন পূর্ব্বে রেলওয়ের স্থানে লৌহবর্ত, টেলিগ্রাফের স্থানে তাড়িতবার্ত্তাবহ প্রভৃতি সংস্কৃত প্রতিশব্দ সৃষ্টি করা হয়েছিল; কিন্তু সেগুলি পোরাণিক বিশ্বামিত্রের সৃষ্টির মতই অচল হয়ে গেছে। আমাদের মনে রাখতে হবে ভাষার ক্ষেত্রে গোঁড়ামি বা ছুমার্গের কোনও স্থান নেই।

 ঘৃণা ঘৃণাকে জন্ম দেয়। গোড়ামি গোড়ামিকে জন্ম দেয়। এক দল যেমন বাংলাকে সংস্কৃত-ঘেষা করতে চেয়েছে, তেমনি আর একদল বাংলাকে আরবী-পারসী ঘেষা করতে উদ্যত হয়েছে। এক দল চাচ্ছে খাঁটি বাংলাকে ‘বলি দিতে, আর এক দল চাচ্ছে ‘জবে করতে। একদিকে কামারের খাঁড়া, আর একদিকে কসাইয়ের ছুরি।