পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (প্রথম খণ্ড).pdf/২৩৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ প্রথম খণ্ড
২১০

পরিশ্রমের দরুন পাকিস্তানের যুবশক্তি আজ দৈহিক দিক দিয়া হীনবল, অকালমৃত্যু আমদের ভাগ্য। আমাদের গড়পড়তা আয়ু আজও ২৬ বছর। অর্থাৎ আমরা পরিণত যৌবন লাভ করার পূবেৰ্বই মৃত্যুবরন করি।

দমননীতিতে বিভীষিকা

 আমরা যুবসমাজ আশা করিয়াছিলাম পরিপূর্ণ গণতান্ত্রিক অধিকার। কিন্তু আজ যখনই আমরা নিজেদের কোন দাবী বা সমাজের উন্নতির জন্য কোন আন্দোলন বা সংগঠনে সমবেত হই, তখনই সরকার আমাদের উপর দমন নীতি প্রয়োগ করেন। ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলন, পাকিস্তান পুলিশের ধর্মঘট, লাহোর বাটা শ্রমিকের ধর্মঘট, করাচী ডালমিয়া সিমেণ্ট ফ্যাক্টরির শ্রমিক ধর্মঘট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিন্মতম বেতনভোগী কর্মচারীদের সমর্থনে ছাত্রদের ধর্মঘট, মেডিকেল ছাত্রদের ধর্মঘট প্রভৃতি ন্যায্য গণতান্ত্রিক আন্দোলনের উপর সরকারী দমন নীতির তীব্র কশাঘাত আমরা পূর্ববাংলা তথা পাকিস্তানের যুবসমাজ আজও ভুলি নাই। মেডিকেল ছাত্রদের ও ডাক্তারদের দাবীর প্রতি সরকারের অনমনীয় মনোভাব আমরা লক্ষ্য করিয়াছি “ভুখা’ চতুর্থ শ্রেণীর কর্ম্মচারীদের বরখাস্তের ব্যাপারও গভীর ক্ষোভের সহিত আমরা লক্ষ্য করিয়াছি।

 সরকারের দমন নীতির কোপে পড়িয়া আজ পাকিস্তানের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রবাদী শত শত যুবক-যুবতী কারাগারে আবদ্ধ। সরকারী দমন নীতির দরুন স্বাধীনভাবে সভা-সমিতি করার বা সংগঠন গড়ার অধিকার আমাদের নাই। নিষ্ঠুর সরকারী দমন নীতির ফলে আমাদের ব্যক্তিস্বাধীনতা আজ বিপর্য্যস্ত। তাই আজ আমাদের পাকিস্তানের যুবসমাজের জীবনে সামাজিক অর্থনৈতিক, আধ্যাত্মিক ও দৈহিক এই চতুবিবধ সংকট নামিয়া আসিতেছে। আমাদের সমাজের অর্থনীতিতে বিদেশী পুঁজির প্রাধান্য আজও অব্যাহত। আমাদের গ্রাম্য অর্থনীতিতে জমিদারী প্রথার নাগপাশ আজও অক্ষত। আমাদের দেশের শিল্প নাই, গণতান্ত্রিক অধিকার নাই। বেকারীর দুঃসহ জালায় আমরা জর্জরিত ও আমাদের দেহ মন স্বাস্থ্য আজ হীনবল। বর্তমান সরকারের নীতিই আমাদের দেশের যুবশক্তির এই মহা সংকটের কারণ।

যুদ্ধ সংকট ও আমলা

 উপরন্তু আমরা গভীর উদ্বেগের সহিত লক্ষ্য করিতেছি যে সাম্রাজ্যবাদী সংকট এড়াইবার জন্য সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহ দুনিয়াব্যাপী আর এক মহাযুদ্ধ বাধাইতে সচেষ্ট নিষ্ঠুর যুদ্ধের আঘাতে কোরিয়া আজ বিধ্বস্ত। প্রতিক্রিয়াশীল সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি সারা এশিয়াতে এবং দুনিয়াব্যাপী এই যুদ্ধের আগুন ছড়াইয়া দিতে চায়। তাহারা দুনিয়াকে গ্রাস করিতে চায়। আমরা গভীর আতঙ্কের সহিত লক্ষ্য করিতেছি যে, আমাদের প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিসমূহও আমাদের দেশকে এই যুদ্ধে জড়াইতে চাহিতেছে। আমাদের যুবসমাজের বেকারীর ও দুর্দ্দশার সুযোগ লইয়া প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিরা আমাদিগকে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের খোরাক হইবার জন্য সৈন্যদলে চাকুরীর লোভ দেখাইতেছে।

 আমরা পূর্ববঙ্গ তথা পাকিস্তানের যুবসমাজ নিজেদের দেশের স্বাধীনতার জন্য সর্ব্বপ্রকার ত্যাগ স্বীকার করিতে এবং যুদ্ধক্ষেত্রে স্বেচ্ছায় প্রাণ দিতে প্রস্তুত। কিন্তু আমরা দৃঢ়কণ্ঠে ঘোষণা করিতেছি যে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধে আমরা কখনও কামানের খোরাক হইব না। আমরা জানি যুদ্ধের আনুষঙ্গিক ফল, সেই ৫০ সনের মন্বন্তরে হইতেও ভয়াবহ মন্বন্তর যে মন্বন্তরে আমরা আমাদের ৩৫ লক্ষ মা-ভাই-বোনকে হারাইয়াছি। আমরা জানি যুদ্ধের অর্থ আমাদের স্কুল-কলেজে আবার মিলিটারীর আস্তানা, আমরা জানি, যুদ্ধের অর্থ ৫০ সনের মত আমাদের শত শত নারীর ইজ্জতহানি, আমরা জানি, এবার যুদ্ধ আরম্ভ হইলে গুলি ও বোমার আঘাতে আমাদের স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, মসজিদ, মন্দির ধ্বংস হইবে। যুদ্ধের এই বিপদ সম্পর্কে আমরা যুবক সমাজ সচেতন হইয়াছি। আমরা পাকিস্তানের যুবসমাজ চাই স্বাধীনতা; শান্তি, সুখ ও উন্নত জীবন।

সরকারী আত্মরক্ষা বর্ম

 অথচ জাতীয় জীবনের এই সমুদয় পুঞ্জীভূত সমস্যা ও সংকট সম্বন্ধে কোন প্রকার প্রশ্ন তুলিলেই সরকার আত্মরক্ষার একাধিক প্রকারের বর্ম পরিধান করিয়া থাকেন। কিছুদিন আগে পর্যন্ত ছিল শিশুরাষ্ট্রের দোহাই। কিন্তু