পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (প্রথম খণ্ড).pdf/২৫৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ প্রথম খন্ড
২৩২

২১শে ফেব্রুয়ারী

 এই দিন সকাল থেকেই শহরের সকল শ্রেণীর মানুষের মধ্যে শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে একটা চরম ঘৃণা ও ত্রাসের সঞ্চার হয়েছে। কর্মীদের প্রবল প্রচারকার্যের ফলে জনসাধারণের মধ্যে আগে থেকেই ধর্মঘটের অনুকূলে মনোভাব সৃষ্টি হয়ে রয়েছে। কর্মীদের প্রচেষ্টায় শহরের সকল অঞ্চলের দোকান-পাট, গাড়ী-ঘোড়া, যানবাহন ও স্কুল-কলেজ বন্ধ হয়ে যেতে লাগল। বেলা ১২টার মধ্যে সকল স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা বিচ্ছিন্নভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে এসে হাজির হলো। প্রায় সাড়ে ১২টার সময় বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে জনাব গাজীউল হকের সভাপতিত্বে সভা অনুষ্ঠীত হল। বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা কমিটির আহ্বায়ক জনাব আবদুল মতিন আন্দোলনের পূর্বাপর পর্যায়ও ১৪৪ ধারা প্রবর্তনের ফলে উদ্ভূত বিশেষ সঙ্কটজনক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করলেন এবং সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের মতামতের উপরই ১৪৪ ধারা সম্পর্কে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়িত্ব ছেড়ে দিলেন।

 তখনই সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের পক্ষ থেকে জনাব শাসমসুল হক ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করে শান্তি পূর্ণভাবে আন্দোলন চালাবার জন্য বৃক্ততা দিলেন। কিন্তু ছাত্রদের আন্দোলন সম্পর্কিত বিভিন্ন প্রশ্নের সম্মুখে বিপর্যস্ত হয়ে তিনি তাঁর সহকর্মীগণসহ সভা থেকে বেরিয়ে যেতে বাধ্য হলেন। অতঃপর ব্যাপকতম পর্যালোচনার পর ভাষার দাবীকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য পরিস্থিতির মোকাবেলা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। ছাত্ররা সুদৃঢ় আত্মচেতনায় ঐক্যবদ্ধ হয়ে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে সংহত অভিমত ঘোষণা করল।

 সঙ্গে সঙ্গে সভা ভঙ্গ করে “দশজনী মিছিল” বের করার জন্য ছাত্ররা শ্লোগন দিতে দিতে গেটের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। গেটের বাইরে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়েছিল আইবি ও পুলিশ বাহিনী। ছাত্রদের প্রথম ‘দশজনী মিশিল’ শ্লোগান দিয়ে বের হতেই পুলিশ এসে গ্রেফতার করে তাদের ট্রাকে ভর্তি করে। দেখতে দেখতেই অসংখ্য ছাত্রকে গ্রেফতার করে অনেকগুলি ট্রাকে ভরে তাদের লালবাগ থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু এত গ্রেফতারের পরও ছাত্রদের দমন করতে না পেরে তাদের ছত্রভঙ্গ করার জন্য পুলিশ তখন কাঁদুনে গ্যাস ছুড়ল রাস্তার পাশে আর বিশ্ববিদ্যায়ের প্রাঙ্গণে। উপর্যুপরি কয়েকবার কাঁদুনে গ্যাস ছোড়ার পর ছাত্ররা যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের পুকুরে ঝাঁপ দিতে থাকে। অনেকেই আবার কাঁদুনে গ্যাসে আহত হয়ে পড়ে রইল বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে। ছাত্ররা তখন উত্তেজনা আর যন্ত্রণায় অধিকতর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে।

 প্রায় বেলা ২টা পর্যন্ত মিছিল করে ছাত্ররা বীরত্বের সঙ্গে গ্রেফতারী বরণ করতে থাকে, আর ধীরে ধীরে তারা মেডিকেল কলেজ হোষ্টেল, মেডিক্যাল কলেজ ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ গেটে গিয়ে জমায়েত হতে থাকে। দলবদ্ধ হয়ে শ্লোগান দিয়ে বের হতেই উদ্ধত পুলিশ বাহিনী এসে তাড়া করে। বেলা প্রায় সোয়া তিনটি সময় এম,এল,এ ও মন্ত্রীরা মেডিক্যাল কলেজের সামনে দিয়ে পরিষদ ভবনে আসতে থাকে। ছাত্ররা যতই শ্লোগান দেয় আর মিছিলে একত্রিত হয় ততই পুলিশ তাদের ওপর বেপরোয়া হানা দিতে থাকে। কয়েকবার ছাত্রদের উপর কাঁদুনে গ্যাস ছুড়ে তাড়া করতে করতে মেডিক্যাল কলেজ হোষ্টেলের ভেতর ঢুকে পড়ে। হোষ্টেল প্রাঙ্গণে ঢুকে ছাত্রদের উপর আক্রমণ করায় এরপর ছাত্ররা বাধ্য হয়ে ইট-পাটকেল ছুড়তে থাকে। একদিকে ইট-পাটকেল আর অন্যদিক থেকে তার পরিবর্তে কাঁদুনে গ্যাস আর লাঠিচার্জ আসে। পুলিশ তখন দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছাত্রদের দিকে লক্ষ্য করে গুলি চালায়। ঘটনাস্থলেই আবদুল জববার ও রফিকউদ্দিন আহম্মদ শহীদ হন, আর ১৭ জনের মত গুরুততভাবে আহত হন। তাঁদের হাসপাতালে সরানো হয়। তাঁদের মধ্যে রাত আটটায় সময় আবুল বরকত শহীদ হন।

 গুলীচালনার সাথে সাথেই পরিস্থিতির অচিন্ত্যনীয় পরিবর্তন সাধিত হয়। তখন ছাত্র-ছাত্রীদের চোখে-মুখে যেন ক্রোধ আর প্রতিহিংসার আগুন ঝরতে থাকে। মেডিক্যাল হোষ্টেলের মাইক দিয়ে তখন পুলিশী হত্যাকাণ্ডের তীব্র প্রতিবাদ করা হয়। আইন পরিষদের সদস্যের প্রতি ছাত্রদের উপর গুলী চালাবার প্রতিবাদে অধিবেশন বর্জন করার দাবীও জানান হয়। ১৪৪ ধারার নাম-নিশানাও তখন আর পরিলক্ষিত হয় না। গুলীচালনার সংবাদ দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়ে শহরের প্রান্তে প্রান্তে। তখনই অফিস-আদালত, সেক্রেটারিয়েট ও বেতার কেন্দ্রের