পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (প্রথম খণ্ড).pdf/২৫৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ প্রথম খন্ড
২৩৩

কর্মচারীরা অফিস বর্জন করে বেরিয়ে আসে। শহরে সমস্ত লোক তখন বিক্ষুব্ধ হয়ে মেডিক্যাল হোষ্টেল প্রাঙ্গণে এসে হাজির হতে থাকে। রাস্তায় আর অলিতে-গলিতে যেন ঢাকার বিক্ষুব্ধ মানুষের ঝড় বয়ে চলে প্রবল বেগে। মেডিক্যাল হোষ্টেলের ব্যারাকে ব্যারাকে শহীদদের রক্তরঞ্জিত বস্ত্রের পতাকা উত্তোলিত হয়েছে। মাইক দিয়ে যখন শহীদানের নাম-ঠিকানা ঘোষণা করা হচ্ছিল তখন সমস্ত মানুষের মন থেকে যেন সমস্ত ভয়-ত্রাস মুছে গেছে, চোখে- মুখে সমস্ত প্রাণশক্তি দিয়ে বর্বর হত্যাকাণ্ডের প্রতিরোধের দুর্জয় শপথ প্রকাশিত হয়ে উঠেছে প্রতিটি মুখের রেখায় রেখায়।

 বাইরের এমনি তুমুল পরিস্থিতির ঢেউ এসে লেগেছে পরিষদ কক্ষে। পরিষদের বিরোধী দলের সদস্যরা নূরুল আমিনের কাছে ছাত্রদের উপর গুলীচালনার কৈফিয়ৎ দাবী করেন এবং পরিষদ মুলতুবি রাখার দাবী জানান। নূরুল আমিন সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠেন, “কয়েকজন ছাত্র গুরুতররূপে আহত হয়েছে শুনে আমি ব্যথিত হয়েছি, তাই বলে আমাদেরকে ভাবাবেগে চালিত হলে চলবে না।” পরিষদ কক্ষেই এমনি জঘন্য মনোবৃত্তির তীব্র প্রতিবাদ উঠলো। লীগ পরিষদ দলের জনাব তর্কবাগীশ বলে উঠলেন, “আমাদের ছাত্রগণ যখন শাহাদাত বরণ করেছেন তখন আমরা আরামে পাখার হাওয়া খেতে থাকব তা আমি বরদাশত করব না।” -এই বলেই তিনি পরিষদ কক্ষ বর্জন করে এসে ছাত্রদের মাইকে পুলিশী বর্বরতার প্রতিবাদে ও আন্দোলনের সপক্ষে বক্তৃতা করলেন।

 রাত্রে পূর্ব হতে জারীকৃত সান্ধ্য আইন আর ১৪৪ ধারার বিন্দুমাত্র চিহ্নও কোথাও রইল না। শহর আর শহরতলীর হাজার হাজার মেয়ে-পুরুষ সেই রাত্রে মেডিক্যাল কলেজ হোষ্টেল প্রাঙ্গণ দেখতে আসে। দেখে মনে হল যারা শহীদ হলো তারা যেন মৃত্যুহীন, তারা যেন বাংলার সকল ধর্মের সকল মতের মানুষের তীর্থক্ষেত্রে পরিণত করেছে এই বধ্যভূমিকে।

২২শে ফেব্রুয়ারী

 এই দিন ভোর থেকেই সলিমুল্লাহ হল, মেডিক্যাল কলেজ, ফজলুল হক হল, মিটফোর্ড মেডিক্যাল স্কুল, জগন্নাথ কলেজের মাইকগুলি সক্রিয় হয়ে ওঠে। সকল কর্মী আর ছাত্রদের আন্দোলনের সঙ্গে যোগাযোগ সাধনের জন্য আহ্বান জানান হয়।

 সকাল বেলা সংবাদপত্রে দেখা গেল মাত্র ৩ জন নিহত, ৩০০ জন আহত ও ১৮০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

 ছাত্রদের উপর গুলীচালনার সংবাদ শুধু শহরেই নয়, দূর-দূরান্তের গ্রামাঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়েছে। শহরের সমস্ত দোকান-পাট, গাড়ী-ঘোড়া, অফিস-আদালত, যান-বাহন বন্ধ করে শ্রমিক-মজুর-কেরানী ও কর্মচারীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে ধর্মঘটে এগিয়ে এসেছে। শহীদদের লাশগুলিকে মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল থেকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে। মেডিক্যাল হোষ্টেলের ভেতর ‘গায়েবী জানাজা’ পড়া হলো। এদিন সমস্ত শহর মিলিটারীর হাতে দেয়া হয়েছে। তবুও দেখতে দেখতে অসংখ্য মানুষ জানাজায় এসে শরিক হলেন। ইমাম সাহেব মোনাজাত করলেন, “হে আল্লাহ, আমাদের অতি প্রিয় শহীদানের আত্মা যেন চিরশান্তি পায়। আর যে জালিমরা আমাদের প্রাণের প্রিয় ছেলেদের খুন করেছে তারা যেন ধ্বংস হয়ে যায় তোমার দেওয়া এই দুনিয়ার বুক থেকে।”

 জানাজা শেষে জনসাধারণকে নিয়ে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। জনাব ওলী আহাদ পরিস্থিতির সামগ্রিক গুরুত্ব বিচার ও কর্মপন্থা ঘোষণা করে বক্তৃতা করলেন। তাঁর মুখ থেকে এক-একটি কথা যেন আগুনের ফুলকির মত বেরুল। সভা শেষ করেই লক্ষাধিক জনতার বিশাল মিছিল বেরোয়। এই শোভাযাত্রার মধ্যখানে হঠাৎ লাঠিচার্জ করার পরও জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে না পেরে গুলী চালায়। এখানে হাইকোর্টের কেরানী সফিউর রহমান শহীদ হন। ছত্রভঙ্গ জনতা তখন হাইকোর্ট আর কার্জন হলের চত্বরে গিয়ে আশ্রয় নেয়। শোভাযাত্রার প্রথম অংশ তবুও ষ্টেশন ও নবাবপুর হয়ে এগুতে থাকে। শোভাযাত্রার এই অংশ সদরঘাট এলে পুনরায় তাদের