পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (প্রথম খণ্ড).pdf/২৬০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ প্রথম খন্ড
২৩৫

 ঢাকার শত সহস্র মানুষকে এক একটি মাইকের সম্মুখে বসে বসে সারা দিন বক্তৃতা শুনতে দেখা যায়। রাত্রে আজিমপুর কলোনীর মেয়েরা এক প্রতিবাদ সভার আয়োজন করেন। সেই সভায় যোগদানের জন্য সেই আমলের সুদূর কমলাপুর থেকেও মেয়েরা আসেন। কয়েক হাজার মহিলা এই প্রতিবাদ সভায় একত্রিত হয়ে সরকারের বর্বর হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ জানান।

২৪শে ফেব্রুয়ারী

 যতই সরকার দমননীতি চালাচ্ছিল ততই জনসাধারণ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সংগঠিত হচ্ছিল। একটানা ৪ দিন তুমুল আন্দোলন চলেছে ঢাকা শহরে। শহর ও গ্রামাঞ্চলের সকল শ্রেণীর মানুষ এসে যোগ দিয়েছে সেই প্রতিরোধ আন্দোলনে। সমস্ত অফিস-আদালত, কল-কারখানা, যানবাহন, ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হয়ে গেছে। এক মিলিটারী ছাড়া আর কোন শক্তিই তখন সরকারের হাতে ছিল না। প্রত্যেকটি মুহূর্তেই সরকারের পতনের আশঙ্কা ছিলো। এমনি পরিস্থিতি দেখে গভর্নর অনন্যোপায় হয়ে অনির্দিষ্টকালের জন্য আইন পরিষদের অধিবেশন বন্ধ করে দিলেন।

 বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ছাত্রদের উপর গুলী চালানোর জন্য তীব্র নিন্দা করেন এবং তারই প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ রাখার সিদ্ধান্তও গ্রহণ করেন।

 মিলিটারী বাহিনী ফজলুল হক হল, জগন্নাথ কলেজ, মিটফোর্ড মেডিক্যাল স্কুল, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ও সলিমুল্লাহ হলের মাইকগুলি জোরপূর্বক ছিনিয়ে নিয়ে যায়। সলিমুল্লাহ হলের পশ্চিম দিকস্থ দরজা ভেঙ্গে মিলিটারী বাহিনী প্রায় ৮০ জনের মত কর্মীকে গ্রেপ্তার করে এবং সলিমুল্লাহ হলের ভিতরে আন্দোলনকারীদের যে সেক্রটারিয়েট বসেছিল তার সমস্ত কাগজপত্র হস্তগত করে নেয়। সন্ধ্যাবেলা মেডিক্যাল কলেজ হোষ্টেলের স্মৃতিস্তম্ভটি মিলিটারী এসে ভেঙ্গে ফেলে।

 জটিলতর পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়ে সর্বদলীয় কর্মপরিষদ আবার সভা আহ্বান করে। সরকারকে ৭৫ ঘণ্টার চরমপত্র দেয়া হয় এবং ৫ই মার্চ প্রদেশব্যপী “শহীদ দিবস” পালনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়; আর আন্দোলনে সর্বমোট ৩৯ জন শহীদ হয়েছেন বলে দাবী করা হয়। ৯ দফা দাবীর ভিত্তিতে সরকারের নিকট নিরপেক্ষ তদন্ত কমিশন দাবী করা হয়।

২৫ শে ফেব্রুয়ারী

 আন্দোলনের চাপে পড়ে কর্তৃপক্ষ অনির্দিষ্টকালের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেন এবং ছাত্রছাত্রীদের হল পরিত্যাগ করে চলে যাবার জন্য নির্দেশ দেন। তখন আন্দোলনের সমস্ত প্রচারযন্ত্র সরকার কেড়ে নিয়েছে। আন্দোলনকারীদের উপর একপক্ষীয় আক্রমণের ফলে চরম সন্ত্রাসের ভাব পরিলক্ষিত হচ্ছিল সারা শহরময়। দেখতে দেখতেই আন্দোলনের মূল ৯ জন কর্মকর্তার উপর গ্রেফতারী পরোয়ানা জারী হয়ে গেল। সরকার যথেচ্ছ গ্রেফতার শুরু করল ছাত্র ও রাজনৈতিক কর্মীদের। সংবাদপত্রগুলিও সম্পূর্ণ{রুপে সুর বদলিয়ে আন্দোলনকারীদের রাষ্ট্রের শত্রু বলে আখ্যা দিতে লাগল। শহরে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম হয়েছে। ফলে আন্দোলন স্বাভাবিকভাবেই আপাতত স্তব্ধ হয়ে গেল।

২৭শে ফেব্রুয়ারী

 রাত্রে পুলিশ এক বাড়ীতে হানা দিয়ে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ৯ জন আত্মগোপনকারী নেতার মধ্যে ৮ জনকে গ্রেপ্তার করে নেয়।

 ৫ই মার্চ ঢাকা শহরে শহীদ দিবস সাফল্যমণ্ডিত হয়নি। অসংখ্য মিলিটারী সারা শহরের অলি-গলি বেষ্টন করে রেখেছিল। তবে মফস্বলে ৫ মার্চ শহীদ দিবস পূর্ণ সাফল্যমণ্ডিত হয়েছিল।