শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
ভাষা বিতর্কের ওপর লেখা তৎকালীন সময় প্রচারিত প্রবন্ধ | নও বাহার | ফেব্রুয়ারী ১৯৫২ |
সকল ভাষার সমান মর্যাদা
আলী আশরাফ
[ভাষা আন্দোলন কিভাবে লক্ষ্যহারা হইয়া নানা পথে ঘুরিয়া বেড়াইতেছে এই প্রবন্ধে তাহার সুন্দর প্রমাণ মিলিবে। প্রবন্ধটি ২১শে ফেব্রুয়ারী তারিখের “নও বেলাল” নামক পত্রিকায় প্রকাশিত হইয়াছিল। পরে ইহা “পূর্ববাংলা” নামক সাপ্তাহিক পত্রের ১৩ই ফাল্গুন সংখ্যায় পুনর্মুদ্রিত হইয়ছে। “নও বেলাল” ও “পূর্ব-বাংলা প্রগতিশীল তরুণ দলের মুখপাত্র। বাংলা ভাষার ইহারা পূর্ণ সমর্থক। কাজেই এই দুইখানি সংবাদপত্রে নূতন কথা শুনায় আমরা সত্যই বিস্মিত হইয়াছি। লেখক যে গতানুগতিক চিন্তা-ধারায় ভাসিয়া যান নাই এবং সমস্যাটির উপর যে কিছুটা নূতন আলোকপাত করিতে পারিয়াছেন, তজ্জন্য আমরা প্রবন্ধটির অংশবিশেষ সংকলিত করিয়া দিলাম]
....পাকিস্তানের “রাষ্ট্রভাষা” হবে বাংলা ও উর্দু- এ মতই বর্তমানে প্রগতিশীল মহলে প্রচলিত। এবং এ মতবাদ থেকেই দাবীও জানানো হচ্ছে যে (যেমন আওয়ামী লীগ নেতারা জানাচ্ছেন) পূর্ববঙ্গের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে যে ভাবে উর্দুকে বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে, সেভাবে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠানগুলিতে বাংলাভাষাকে বাধ্যতামূলক করা হোক।
“অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই” এই দ্ব্যর্থবোধক আওয়াজই আজ বিকশিত হয়ে “বাংলা ও উর্দু রাষ্ট্রভাষা চাই”-এই সুস্পষ্ট আওয়াজেরই রূপ ধারণ করেছে। প্রগতিশীল মহল সাধারণভাবে ভাবছেন যে, এটাই হলো পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার সমস্যা সমাধানের পথ। কিন্তু সত্যই কি তাতে সমস্যার পরিপূর্ণ ও গণতন্ত্রসম্মত সমাধান হবে? ২১শে ফেব্রুয়ারী যে গৌরবময় সংগ্রাম অনুষ্ঠিত হয়েছিল, বাংলা ও উর্দু এ দুটি ভাষা পাকিস্তানের “রাষ্ট্রভাষা” হলেই কি সে সংগ্রামের উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ সফল হবে এটাই কি গণতন্ত্র? না, এতে সমস্যার সমাধান হবে না, এটা গণতন্ত্রও নয়। কারণ, যে নীতি অনুসারে আমরা আমাদের মাতৃভাষার অধিকার চাইছি, সে নীতি অনুসারেই অন্যান্যকেও তাঁদের ভাষার অধিকার দিতে হবে। পাকিস্তানের জনগণ শুধু বাংলা ও উর্দু এ দুটি ভাষায় কথা বলে না। পাকিস্তানে শুধু যে বাংলা ভাষাভাষী জনগণই রয়েছে তা নয়, এ রাষ্ট্রের অধীনে আরো রয়েছে সিদ্ধি ভাষাভাষী, পাঞ্জাবী ভাষাভাষী, পুস্তু ভাষাভাষী, বেলুচ ভাষাভাষী ও গুজরাটী ভাষাভাষী জনগণ। এছাড়া রয়েছে কয়েকটি উপজাতি- যাদের রয়েছে স্থানীয় ডায়লেক্ট, মুসলিম লীগ সরকারও বাংলা, উর্দু, সিন্ধি, পাঞ্জাবী, পুস্তু, বেলুচী ও গুজরাটী- এই সাতটি ভাষাকে পাকিস্তানের জনগণের ভাষা বলে স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন। বস্তুতঃ পাকিস্তানের রয়েছে পাঁচটি প্রধান প্রধান জাতি- বাঙালী, সিন্ধি, পাঞ্জাবী, পাঠান ও বেলুচী। এদের প্রত্যেকের নির্দিষ্ট, স্থায়ী, অবিচ্ছিন্ন বাসভূমি আছে, প্রত্যেকেরই নিজস্ব একটি অর্থনৈতিক জীবন আছে, প্রত্যেকের নিজস্ব মানসিক গঠন ও কৃষ্টি রয়েছে এবং প্রত্যেকের রয়েছে নিজ নিজ মাতৃভাষা।
মুসলিম লীগ এই বাস্তব সত্য অস্বীকার করে এক জাতি, এক তমদুন, এক ভাষার প্রতিক্রিয়াশীল যুক্তির অবতারণা করে উর্দুকে “রাষ্ট্রভাষা” করতে চাইছেন। এই পরিস্থিতিতে যদি গণতন্ত্রী কর্মীরাও শুধু বাংলা ও উর্দুকে “রাষ্ট্রভাষা” করতে চান, তাহলে সিন্ধিভাষী পুস্তুভাষী, পাঞ্জাবীভাষী, বেলুচীভাষী ও গুজরাটীভাষী জনগণের উপর ঐ দুটো ভাষা চালিয়ে দেয়া হবে। এটাও স্বৈরাচার ও গণতন্ত্রবিরোধী কাজেই “বাংলা ও উর্দু রাষ্ট্রভাষা হোক”- এ দাবী কখনোই পরিপূর্ণ গণতন্ত্রসম্মত নয়। “অন্যতম রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই”- এই দ্ব্যর্থবোধক আওয়াজ, যে আওয়াজ থেকেই শুধু বাংলা ও উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবী এসেছে, সেই আওয়াজ