পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (প্রথম খণ্ড).pdf/২৬৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ প্রথম খণ্ড
২৩৯

আজ পরিত্যাজ্য আন্দোলনের প্রথমস্তরে জনগনের সে আওয়াজ প্রচলিত হয়েছিল। কিন্তু মহান একুশে ফেব্রুয়ারীর এক বৎসর পর যখন জনগনের অভিজ্ঞতা ও গনতান্ত্রিক চেতনা আরও বেড়ে গেছে, তখন আন্দোলনের মূল দাবীরুপে ঐ দ্ব্যর্থবোধক আওয়াজের কোন আন্দোলনের ব্যপকতা বৃদ্ধি ও অগ্রগতির পথে বাধা হচ্ছে। তার প্রমাণ হলো, সে আওয়াজ সিন্ধিভাষী, প্রভৃতি জাতির গণতান্ত্রিক দাবীকে আমল না দিয়ে শুধু বাংলা ও উর্দুকে “রাষ্ট্রভাষা”র আসনে বসাতে চাইছে এতে ভাষা আন্দোলনের পিছনে সিন্ধিভাষী, পুস্তুভাষী, বেলুচীভাষী, পাঞ্জাবীভাষী প্রভৃতি সারা পাকিস্তানের সাধারন জনতাকে সমাবেশ করা যাচ্ছে না। বরং তারা এর বিরুদ্ধে ক্ষেপে উঠবে। উর্দুকে পূর্ববঙ্গে এবং পশ্চিম পাকিস্তানে বাংলাকে বাধ্যতামূলক করার দাবীও অগণতান্ত্রিক। কোন ভাষাভাষী জনগনের উপর অন্য ভাষাকে বাধ্যতামূলক ভাবে চাপিয়ে দেওয়াটা স্বৈরাচারের অভিব্যক্তি। এভাবে, এক ভাষা অপরের ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক করলে জনগনের শিক্ষা ব্যাহত হয় ও জাতিগত বিরোধ সৃষ্টি হয়। পূর্ববঙ্গে উর্দু ও পশ্চিম পাকিস্তানে বাংলা বাধ্যতামূলক করার আওয়াজ দিয়ে প্রকৃতপক্ষে জাতিগত বিরোধ সৃষ্টি হচ্ছে। কাজেই, এ আওয়াজ পরিত্যাজ্য।

 বহু ভাষাভাষী জনগণের অর্থাৎ বহু জাতির মিলনক্ষেত্র পাকিস্তানের ভাষা সমস্যার গণতন্ত্রসম্মত সমাধানের জন্য আমাদের আন্দোলনের মূলনীতি হবেঃ ছোট- বড় প্রত্যেকটি ভাষাভাষী জনগণের প্রত্যেকটি ভাষাকে সমান মর্যাদা ও সমান অধিকার দেয়া। বিভিন্ন ভাষাভাষী সাধারণ জনগণ যাতে রাষ্ট্রপরিচালনায় অংশগ্রহণ করতে পারে ও শিক্ষার পূর্ণ সুযোগ পায়, তার জন্য এ আন্দোলনের দাবী হবে নিম্নরূপঃ

 (ক) কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রের সমস্ত আইন, ঘোষণা, দলিল, প্রভৃতি বাংলা, উর্দু, সিন্ধি পাঞ্জাবী, পুস্তু ও বেলুচী ভাষায় প্রকাশ করতে হবে। গুজরাটী ভাষাভাষী জনসংখ্যা যদি যথেষ্টসংখ্যক হয়ে থাকে তবে সে ভাষায়ও প্রকাশ করতে হবে।

 (খ) কেন্দ্রীয় আইন সভায় প্রত্যেক সভ্য নিজ নিজ মাতৃভাষায় নিজ নিজ মাতৃভাষায় নিজ বক্তব্য বলতে পারবেন ও দোভাষীরা সেগুলি বিভিন্ন ভাষায় তর্জমা করে দেবেন। (জাতিসংঘে ও সোভিয়েট যুক্তরাষ্ট্রে এ ব্যবস্থা সাফল্যের সঙ্গে চলছে।)

 (গ) প্রত্যেক ভাষাভাষী জনগণের নিজ নিজ বাসভূমির (অর্থাৎ বিভিন্ন প্রদেশের) রাষ্ট্রকার্য্য, আইন আদালতের কার্য সে প্রদেশের ভাষায় চলবে। বিভিন্ন প্রদেশে অবস্থিত অন্য ভাষাভাষীরা (যেমন পূর্ববঙ্গের উর্দুভাষীরা বা পাঞ্জাবের বাঙালীরা) সে সব প্রদেশের আইন- আদালতে নিজ নিজ মাতৃভাষায় নিজ বক্তব্য বলতে পালাবে।

 (ঘ) বিভিন্ন উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চলে সেসব উপজাতীয় ভাষায় আইন-আদালতের কাজ চলবে।

 (ঙ) ছোটু বড় প্রত্যেক ভাষাভাষী জনসমষ্টি ও বিভিন্ন প্রদেশে সংখ্যালঘুরাও নিজ নিজ মাতৃভাষায় শিক্ষা লাভ করার অধিকার ভোগ করবে। এই সমস্ত দাবীগুলির সারমর্ম নিয়ে আমাদের আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত অভিব্যক্তিরূপে মূল শ্লোগান বা আওয়া হবে।

“সকল ভাষার সমান মর্যাদা চাই”


আলী আশরাফ নামটি ছদ্মনাম। লেখকের আসল নাম খোকা রায়। তিনি তৎকালীন কমিউনিষ্ট পার্টির সদস্য ছিলেন।