পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (প্রথম খণ্ড).pdf/২৬৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ প্রথম খন্ড
২৪১

পূর্ব পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র

 ২১ শে ফেব্রুয়ারী তারিখে ঢাকায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হওয়ার পূর্ব হইতেই সরকার সংবাদ পাইতেছিলেন যে, যাহারা পাকিস্তান পরিকল্পনাকে একটি অভিসম্পাত বলিয়া বিবেচনা করিত, পাকিস্তান অস্তিত্বকে যাহারা পথের কাঁটা বলিয়া মনে করিত এবং পাকিস্তান ধ্বংস করার চিন্তা যাহারা কখনও ত্যাগ করে নাই তাহারা পুনরায় তৎপর হইয়া উঠিয়াছে। এই দল বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যেও কাজ করিতেছিল এবং কিছুসংখ্যক ছাত্রকে ভুল পথে পরিচালিত করিতেছিল। দেশে উচ্ছৃঙ্খলার সৃষ্টি করিয়া শাসনব্যবস্থাকে জবরদস্তিক্রমে বানচাল করিয়া দিবার জন্য ইহারা ব্যাপক পরিকল্পনা করিতেছিল। তাহারা শধু সুযোগের প্রতীক্ষায় ছিল। কায়েদে আজম ও কায়েদে মিল্লাতের জীবদ্দশায় ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপে লিপ্ত এই সকল লোক নীরব ছিল। কায়েদে মিল্লাতের শাহাদাতের পর তাহারা সুযোগের সন্ধান পায়। বাংলাভাষা প্রশ্নটি স্বভাবতঃই সকলের ভাবাবেগ আকর্ষণ করে বলিয়া উহার আড়ালে এই সকল লোক তাহাদের হীন প্রচেষ্টা লুক্কায়িত রাখিবার সুযোগ পায়।

 সবদিক বিবেচনা করিয়া দেখিলে এই কথাই সুস্পষ্ট হইয়া ওঠে যে, প্রাদেশিক আইন সভার অধিবেশনের প্রথম দিন হইতে আরম্ভ করিয়া যত দিন দরকার হয় তত দিন গোলমাল বাধাইয়া রাখিবার পরিকল্পনা করা হইয়াছিল। সরকার খবর পাইয়া সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসাবে ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারী করেন। বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করিবার জন্য জনসাধারণের নিয়মতান্ত্রিক দাবীকে দাবাইয়া রাখিবার কোন প্রশ্নই ইহার মধ্যে ছিল না। ঘটনার মাত্র পক্ষকাল পূর্বেও ঢাকায় এবং অন্যান্য জায়গায় এই সম্পর্কে সভার অনুষ্ঠান ও শোভাযাত্রা বাহির করা হইয়াছিল। কিন্তু স্থানীয় কর্তৃপক্ষ কোথাও কোন হস্তক্ষেপ করেন নাই। ১৪৪ ধারা জারি করিয়া এ ধরনের সভা ও শোভাযাত্রা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয় নাই। জেলা কর্তৃপক্ষের অনুমতি লইয়া উহা করা যাইত। কিন্তু কেহ এইরুপ কোন অনুমতি চান নাই। ইহার পরবর্তী ঘটনাবলী হইতে সরকারের প্রাপ্ত সংবাদেরই সুস্পষ্ট সমর্থন পাওয়া যায় যে, যে সকল লোক গোলযোগ সৃষ্টির ষড়যন্ত্র করিতেছিল, রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নটি তাদের এই হীন ষড়যন্ত্রের প্রতি জনসাধারণের সমর্থন লাভের একটি হাতিয়ার ব্যতীত আর কিছুই নহে।

ভাষা-বিতর্ক

 পাকিস্তানের অন্যান্য শুভাকাঙ্খীদের মত আমিও আশা করিয়াছিলাম যে আমাদের দেশবাসী তাহাদের জ্ঞানবুদ্ধি, ইসলাম-প্রীতি ও পাকিস্তানের প্রতি দরদবোধে নিজেদের আভ্যন্তরীণ বাদ-বিসম্বাদ ভুলিয়া যাইবেন এবং দেশপ্রেমিক নাগরিক হিসাবে ঐক্যবদ্ধ ঢাকায় সাম্প্রতিক গোলযোগের মত জাতীয় বিপদের প্রতিরোধ করিতে প্রস্তুত হইবেন। ইসলাম ও পাকিস্তানের শত্রুরা সাময়িকভাবে হইলেও কিছুটা সাফল্য লাভ করিয়াছে এবং আমাদের কোমলমতি যুবক ও জনসাধারণের মধ্যে কিছু লোককে বিভ্রান্ত করিতে পারিয়াছে দেখিয়া আমি দুঃখিত। ঢাকার সাম্প্রতিক গোলযোগের পিছনে যাহারা আছে তাহাদের কর্মপদ্ধতি ও তাহারা যেভাবে নিজেদের ইচ্ছা জনগণের উপর চাপাইয়া দিতে চাহিয়াছিল, তাহা হইতে অতি সহজেই বুঝা যায় তাহাদের উদ্দেশ্য কি ছিল। জনসাধারণের অনেকেই রাষ্ট্রের দুশমনদের চক্রান্ত বুঝিতে না পারিয়া তাহাদের ফাঁকে পড়িয়াছিলেন বলিয়া আমি মর্মাহত হইয়াছি। আরো বহুদিন পর্যন্ত ইংরেজী ভাষা পাকিস্তানে চালু থাকিতে বাধ্য বলিয়া রাষ্ট্রভাষায় আশু মীমাংসা অত্যাবশ্যকীয় মনে করা হয় নাই। এই অবস্থায় যথা সময়ে স্বাভাবিক অবস্থা বিবর্তনের ভিতর দিয়া এই সমস্যা সমাধান করাই সংগত বিবেচিত হইয়াছিল। আপনারা জানেন, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা হওয়ায় আমাদের জাতীয় জীবনে নবীন প্রাণধারা ও নূতন অবস্থার সঞ্চার হইয়াছে এবং ফলে উর্দূ বাংলা উভয় ভাষারই নিত্যপরিবর্তন ঘটিতেছে। উর্দূভাষী ও বাংলাভাষী লোকদের পারস্পরিক মিলনের ফলে দুইটি ভাষার সমৃদ্ধ হইতে এবং এক ভাষার শব্দ অন্য ভাষায় ব্যবহৃত হইতে থাকায় দুই ভাষাভাষী নাগরিকদের ব্যবধান ক্রমেই দূর হইতেছে। এই জন্যই মরহুম কায়েদে আজম এবং কায়েদে মিল্লাত অযথা তাড়াতাড়ি করিয়া এ সম্পর্কে গণপরিষদের নিকট হইতে কোন সিদ্ধান্ত করানের প্রয়োজন মনে করেন নাই। বাংলাভাষা যথাসময়ে এই প্রদেশের সরকারী ভাষা হইবে, ইত্যবসরে ইহা স্বীকার করিয়া পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিভা ও সংস্কৃতির উপযোগী করিয়া তোলার সর্বপ্রকার প্রচেষ্টাকে সরকার উৎসাহ প্রদান করেন।