পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (প্রথম খণ্ড).pdf/২৮৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ প্রথম খন্ড
২৬১

প্রয়োজন কোনকালেও হয়নি। ছাত্র ও জনসাধারণ এই হঠকারিতায় ভয়ানক বিক্ষুব্ধ হয়। কিন্তু কর্মপরিষদ সভা আহ্বান করে তৎক্ষণাৎ ঘোষণা করে যে শান্তিপূর্ণ হরতাল পালন করা হবে, কিন্তু নিষেধাজ্ঞার দরুন সভা ও শোভাযাত্রা বন্ধ রাখা হবে।

 একুশে তারিখের মর্ম্মন্তুদ ও শোকাবহ ঘটনাবলীর পুনরাবৃত্তি করে আপনাদের মনে কষ্ট দিতে চাই না। ঐদিন বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ছাত্রদের শান্তিপূর্ণ সুশৃঙ্খল সভা করার সময় চারিদকে সশস্ত্র পুলিশের পাহারা, সভা ভঙ্গের পর ইতস্তত গমনরত ছাত্রদের উপরে লাঠিচার্জ, কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপ, দলে দলে ছাত্রদের গ্রেফতার এবং শেষ পর্য্যন্ত মেডিকেল ছাত্রাবাসের ভেতর অনধিকার প্রবেশ করে নিরস্ত্র ছাত্রদের উপর বেপরোয়া গুলী চালনা ও মৃত্যুর ঘটান এবং অসংখ্য ছাত্র জখম-এ দৃশ্য কারবালার দৃশ্যকেও হার মানিয়ে দিয়েছে। সভ্য জগতে এর দৃষ্টান্ত বিরল। সারা শহরের প্রত্যেকটি নর-নারীর মনে শোকের ছাড়া পড়ে গেলো। এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রত্যেকটি নাগরিক প্রতিবাদ করে উঠলো।

 পরদিন সারা শহরে শোকার্ত্ত মিছিল; বিক্ষুব্ধ জনতার তীব্র নিন্দা শহরের প্রতি কোণে ধ্বনিত হলো। এই দিনও পুলিশ গুলী চালিয়ে কতিপয় লোকের মৃত্যু ঘটায় ও অনেকগুলি লোককে জখম করে।

 পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, শহরে কয়দিন “সরকার” ছিল বলে মনে হয় না। একুশে বাইশের ঘটনা যারা দেখেছেন তাঁরাও একথা মনে করেছেন যে কোন সুসভ্য ও গণতান্ত্রিক সরকার তখন ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত ছিল না, কারণ নিরস্ত্র, শান্তিপ্রিয় ও সুশৃঙ্খল তরুণ সরলপ্রাণ ছাত্রদের উপর কোন সরকার কোন অবস্থায়ই গুলী চালাতে পারে একথা চোখে দেখলেও অনেকে বিশ্বাস করতে রাজী হবেন না।

 এত বড় অন্যায় কাজ করার ফলে সরকারের আসন টলমল করে উঠলো। চারদিক থেকে মন্ত্রিমণ্ডলীর গদী ছাড়ার দাবী তীব্রভাবে জানানো হতে লাগলো। মন্ত্রী সমর্থক সদস্যরাও পদে ইস্তফা দিতে কৃতসঙ্কল্প হলেন। এটা পরিষ্কার বুঝা গেল যে এই মন্ত্রিত্ব আর একদিনও টিকে থাকতে পারছে না। ঠিক এমনি সময়ে পরিষদের অধিবেশন হঠাৎ বন্ধ করে দেওয়া হলো। মন্ত্রিমণ্ডপী হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন- চাকরি রয়ে গেলো।

 এর আগেই বেগতিক দেখে নুরুল আমিন সাহেব রাষ্ট্রভাষা সম্বন্ধে একটি সোপারেশ প্রস্তাব পরিষদে পাশ করিয়ে নিয়ে জানিয়ে দিলেন যে এর পর আন্দোলনের আর কোন দরকার নেই। বশংবদ পত্রিকাগুলিও সুরে সুর মিলিয়ে গাইতে লাগলো। পরবর্তীকালের ঘটনাবলী পরিষ্কাররূপে প্রমাণ করেছে যে আন্দোলনের কত প্রয়োজন ছিল এবং আছে সরকারের ঘোষণা ও মিষ্টিবুলি কত মারাত্মক ধোঁকাবাজী।

 সরকার কিন্তু নির্ম্মম হত্যাকাণ্ডের কোন কৈফিয়ৎই দিবার চেষ্টা করেন নি। পক্ষান্তরে মন্ত্রীত্বের সিংহাসন অবৈধ উপায়ে নিরাপদ করতে দমন নীতির আশ্রয় গ্রহণ করলেন। নানা প্রকারের কুয়াশার জাল সৃষ্টি থেকে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকে বানচাল করে দেওয়ার জন্য নিতান্ত জঘন্য মিথ্যা প্রচার আরম্ভ করে দিলেন। প্রথম থেকে বাঙালী-অবাঙালী বিরোধ সৃষ্টি করার প্রচেষ্টাও চলছিল, কিন্তু সে চেষ্টা সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়। গোটা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন কম্যুনিষ্ট রাষ্ট্রদোহী ও বিদেশী দালালদের দ্বারা পরিচালিত হয়েছিল এবং তারাই ছাত্রদের উস্কানি দিয়ে মৃত্যুর দুয়ারে ঠেলে দিয়েছে, রাজনৈতিক সুবিধাবাদীরা এর সাথে হাত মিলিয়ে সহায়তা করেছে, ফলে গোটা রাষ্ট্রটাই বিপন্ন হয়ে পড়েছিলো এই সব প্রচার করে লক্ষ লক্ষ ইস্তাহার হাওয়াই জাহাজে দেশময় ছড়িয়ে সরকার দেশে একটা ভীষণ আতঙ্কের সৃষ্টি করে তোলেন। মুসলিম লীগও সময় বুঝে ঠিক ঐ মর্ম্মে প্রস্তাব পাশ করে দেশবাসীকে সাবধান করে দেন, যেন কেউ এসব আন্দোলনে যোগ না দেন। সঙ্গে সঙ্গে ধরপাকড় আরম্ভ হয়ে যায়। ছাত্র, যুব কর্মী, পরিষদের সদস্য, বিরোধী দলের নেতা ও কর্মী, এবং কতিপয় অধ্যাপককে জেলে ঢোকানো হলো। সলিমুল্লা মুসলিম হলে হামলা করে অনেকগুলি ছেলেকে ধরে আনা হলো। শহীদদের স্মৃতির প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্যে ছাত্রবন্ধুগণ মেডিকেল কলেজ হোস্টেলে যে স্মৃতিস্তম্ভ গড়ে তুলেছিলেন সরকার তা নির্ম্মমভাবে ধূলিসাৎ করেন। ববর্বরতার এমন নজির কোথায়ও মিলে না।