পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (প্রথম খণ্ড).pdf/২৮৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ প্রথম খন্ড
২৬৩

পূর্ব্ব বাংলার প্রতিটি নাগরিক বুঝতে পারলো এ সমস্যার সমাধান তারা কখনও করবে না। এদিকে মুসলিম লীগের পাণ্ডারা কেউ কেউ দেশে ফিরে এসে এর কৈফিয়ৎ দিতে গিয়ে নতুন নতুন ভাঁওতা সৃষ্টি করলেন; জনসাধারণের ন্যায্য ও পবিত্র দাবী দাবিয়ে রাখার অপরাধের সাফাই গাইতে হবে ত!

 পূর্ব্ব পাকিস্তানের জনগণ আজ জাগ্রত। বুলেটের সামনে বুক পেতে দিয়ে তারা জগতকে দেখিয়ে দিয়েছে যে সমগ্র জাতির ন্যায্য দাবী কোন স্বৈরাচারী সরকারই কোন হিংস্র উপায় অবলম্বনে দমিয়ে রাখতে পারে না। জীবন দিয়ে যে জাতি তার দাবীর সভ্যতা ও পবিত্রতা প্রমাণ করেছে সে দাবীকে অগ্রাহ্য করবার সাধ্যি কারো নেই।

 বন্ধুগণ, মুসলিম লীগ ও লীগ সরকারের কার্যাবলী আজ আয়নার মত আপনাদের চোখের সামনে তার বিশ্লেষণ বা তফছিরের কোন প্রয়োজন নেই-বন্ধুবেশে এরা গত পাঁচ বছরে আমাদের জাতীয় জীবনকে বিষিয়ে তুলেছে-প্রত্যেকটি সমস্যাকে ধামাচাপা দেবার জন্য এরা চিরদিন চেষ্টা করে এসেছে। এত বড় একটা স্বতঃস্ফূর্ত্ত আন্দোলনের ভিতরও ভাঙ্গন ধরাবার জন্য এরা নানা অলীক ও মিথ্যা অভিযোগ সৃষ্টি করেছে, দালাল লেলিয়ে দিয়েছে, মানুষের মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। সরকার ও মুসলীম লীগ জানে যে, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ সমবেত কণ্ঠে তাদের বিরুদ্ধে রায় দিয়েছে, তাই কায়েমী স্বার্থ রক্ষার জন্যে তারা জনগণের বুকে দিয়েছে মারণ কামড়। যে উপায়ে হোক এ আন্দোলনকে দাবীয়ে দিতে পারলে কিংবা অন্ততঃ ভাঙ্গন ধরাতে পারলেও তাদের খানিকটা লাভ। সেই লাভের আশায় তারা নতুন নতুন ফন্দী আবিষ্কার করে যাচ্ছেন। এদের অনেককে আমরা দেখেছি আন্দোলনের পুরোভাগে অংশগ্রহণ করে আন্দোলনকে বিপথগামী করার চেষ্টাও করেছেন। তা’ না পেরে শেষে পাততাড়ি গুটিয়ে উল্টা সুর গাইতে শুরু করেছেন।

 সবর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা পরিষদ দাবী জানিয়েছিল যে, সরকারের কার্য্যাবলী তদন্ত করার জন্য সরকারী ও বেসরকারী সদস্য দ্বারা গঠিত প্রকাশ্য তদন্ত কমিশন নিযুক্ত করা হোক। সে দাবী উপেক্ষা করে মাত্র একুশে তারিখের পুলিশের গুলীবর্ষণ আইনসঙ্গত হয়েছিল কিনা- এ ব্যাপারে তদন্ত করার জন্যে একটি গোপন তদন্ত কমিশন নিযুক্ত করা হয়েছে। বাইশে তারিখের ঘটনাবলী সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা হয়েছে। একশ’ {{SIC|চুয়াল্লি|চুয়াল্লিশ} ধারা জারি করার কোন আইনসঙ্গত কারণ ছিল কিনা সে সম্পর্কে কোন প্রশ্ন উত্থাপিত হবে না। অথচ এই নিষেধাজ্ঞাই সমস্ত দুর্ঘটনার জন্যে দায়ী। পূর্ব পাকিস্তানের যেসব জায়গায় নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়নি সেখানে কোন গোলমালই ঘটেনি। সুতরাং কমিশন নিযুক্তির ব্যাপারেও সরকার যে জনগণকে ধোঁকা দিয়েছেন তা স্পষ্ট বোঝা যায়। জনসাধারণ ও ছাত্র সমাজের দিক দিয়ে তদন্তের কোন মূল্যই নেই। তাই রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ এতে যোগদান করেনি।

 কথা এখন মুসলিম লীগ ও লীগ সরকারকে নিয়ে নয়, কথা হচ্ছে এখন আমাদের নিয়ে। সরকার প্রচার করছে যে, মুসলিম লীগ ও সরকারের রোপিত ‘বিষবৃক্ষ’ ফল দিতে আরম্ভ করেছে জনসাধারণ দমে গিয়েছে, ছাত্র সমাজও ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে। বাংলা ভাষার দাবী মেটাবার ভার মুসলিম লীগ ও সরকার গ্রহণ করেছে-কথাটা বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হচ্ছে না। এত বড় একটা স্বতঃস্ফূর্ত্ত আন্দোলন কতকগুলি মিথ্যা ভাঁওতার চাপে দমে যাবে-যে জাতি জীবন দিতে শিখেছে সে জাতি সন্ত্রস্ত হয়ে পড়বে-এরূপ কল্পনা করা অন্যায়। সাময়িক প্রতিক্রিয়া বিশ্বাসপ্রবণ সরল মনে কিছুটা কুয়াশা সৃষ্টি করতে পারে কিন্তু তার অন্তরের অন্তঃস্তলে বাসা বাঁধতে পারে না। প্রয়োজন হলে সে আবার দাঁড়িয়ে উঠে, বুক ফুলিয়ে অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে তার স্বরূপ প্রকাশ করতে পারে।

 বন্ধুগণ, জানি আপনাদের উপরও সরকারের আক্রোশ কম নয়-আপনারাও কম নির্যাতন ভোগ করেননি-কিন্তু তা সত্ত্বেও যে আজ এখানে সমবেত হয়েছেন এতেই স্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে সরকারের বুজরগী ব্যর্থ ও বিফল হয়ে গিয়েছে। তারাই যে পাকিস্তান ও ইসলামের একমাত্র রক্ষক আর পূর্ব্ব পাকিস্তানের জনসাধারণের মনে পাকিস্তান ও ইসলামের জন্যে বিন্দুমাত্র দরদ নেই- এ কথা বলে যে দুর্বিষহ অপমানের ভার আমাদের ঘাড়ে