পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (প্রথম খণ্ড).pdf/৩৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্রঃ প্রথম খণ্ড
শিরোনাম সূত্র তারিখ
পূর্ব পাকিস্তান রেনেসাঁ সোসাইটি সংক্রান্ত দলিল বুদ্ধির মুক্তি ও রেনেসাঁ আন্দোলনঃ মোহাম্মদ মাহফুজুল্লাহ ১৯৪৩ সাল

বুদ্ধির মুক্তি ও রেনেসাঁ আন্দোলন

 (সাবেক) পাকিস্তান-পূর্বকালেই মুজীবুর রহমান খাঁ তাঁর ‘পাকিস্তান’ শীর্ষক গ্রন্থে পাকিস্তানের (সাবেক) গ্রন্থে এবং আব্দুল হক, ফররুখ আহমদ প্রমুখ আরও অনেকের রচনায় বিভাগ-পূর্বকালেই (সাবেক) পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার প্রসঙ্গ আলোচিত হয়েছিল। এ সম্পর্কে ১৩৫০ সালে (১৯৪৩) একটি অত্যন্ত মূল্যবান প্রবন্ধ লেখেন আবুল মনসুর আহমদ। ১৩৫০ সালের কার্তিক সংখ্যা মাসিক মোহাম্মদীতে প্রকাশিত ‘পূর্ব পাকিস্তানের জবান’ শীর্ষক এই গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধটিতে তিনি বিভাগ-পূর্বকালেই বলেনঃ

 “মুসলিম লীগ রাজনীতিতে ‘জাতীয়তা যে সংজ্ঞা নির্ধারিত হয়েছে, তাতে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের স্বাতন্ত্র্য ও স্বাধীনতা সুস্পষ্টভাবে স্বীকৃত ও সম্ভব হয়ে উঠেছে।”

 এই প্রেক্ষিতে উর্দুকে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা ও জাতীয় ভাষারূপে চাপিয়ে দেবার বিপদ ও ষড়যন্ত্র সম্পর্কে ঐতিহাসিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ভাষাতাত্ত্বিক ও রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে আলোকপাত করে আবুল মনসুর আহমদ ১৯৪৩ সালেই বলেছিলেনঃ

 “এত করেও বাংলার চার কোটি বাঙলাভাষী মুসলিম জনসাধারণ হাজার বছরেও উর্দু-ভাষী হবে না... লাভের মধ্যে হবে একশ্রেণীর অভিজাত সম্প্রদায়ের সৃষ্টি। এদের সঙ্গে জনসাধারণের কোন যোগ থাকবে না, একথাও আগে বলেছি। কিন্তু এরা পশ্চিমাদের গলার সুর মিলিয়ে উর্দুর মাহাত্ম্য গেয়ে যাবেন। কারণ এরাই হবেন পশ্চিমাদের এ দেশী আত্মীয় এবং পূর্ব পাকিস্তানের এ্যাংলো-ইণ্ডিয়ান শাসক শ্রেণী। শাসক শ্রেণীর ভাষা থেকে জনসাধারণের ভাষা পৃথক থাকার মধ্যে মস্ত বড় একটি সুবিধে আছে। তাতে অলিগাকী ভেঙে প্রকৃত গণতন্ত্র কোনদিন আসতে পারেনা; সুতরাং পূর্ব পাকিস্তানের প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার রোকাওট হিসাবে রাজনৈতিক মতলবে এই অভিজাত শ্রেণী উর্দুকে বাঙলার ঘাড়ে চাপিয়ে রাখবেন। শুধু চাকরীতেই নয়, আইনসভার মেম্বরগিরিতেও যোগ্যতার মাপকাঠি হবে উর্দু-বাগিতা। সুতরাং সেদিক দিয়েও এই ভাষাগত আবিজাত্যের স্টীলফ্রেম ভেঙে যাবার সম্ভাবনা থাকবে না। উর্দুকে পূর্ব-পাকিস্তানের জাতীয় ভাষা করবার চেষ্টার বিপদ এইখানে... অথচ উর্দু নিয়ে এই ধস্তাধস্তি না করে আমরা সোজাসুজি বাঙলাকেই যদি পূর্ব-পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা ও জাতীয় ভাষারূপে গ্রহণ রাষ্ট্রীয়, সামাজিক, শিক্ষাগত, অর্থনৈতিক ও শিল্পগত রূপায়ণে হাত দিতে পারবো। আমাদের নিজেদের বৃদ্ধি, প্রতিভা ও জীবনাদর্শ দিয়েই আমাদের জনসাধারণকে উন্নত, আধুনিক জাতিতে পরিণত করবে। জাতির যে অর্থ শক্তি, সময় ও উদ্যম উর্দু প্রবর্তনে অপব্যয় হবে, তা যদি আমরা শিক্ষা-সাহিত্য, শিল্পে-বাণিজ্যে নিয়োজিত করি, তবে পূর্ব পাকিস্তানকে আমরা শুধু ভারতের নয়, সমগ্র মুসলিম জগতের এমনকি গোটা দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ দেশে পরিণত করতে পারবো।”


(পূর্ব-পাকিস্তানের জবান, মাসিক মোহাম্মদী, কার্তিক, ১৩৫০)