পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (প্রথম খণ্ড).pdf/৩৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্রঃ প্রথম খণ্ড
১০

 পূর্ব পাকিস্তানের জবান’ শীৰ্ষক এই গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধটিতে তিনি বলেন, “জিন্না-নেতৃত্বের বাস্তববাদী দূরদর্শিতার গুণে মুসলিম লীগ রাজনীতিতে ‘জাতীয়তার যে সংজ্ঞা নির্ধারিত হয়েছে, তাতে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের স্বাতন্ত্র্য ও স্বাধীনতা সুস্পষ্টভাবে স্বীকৃত ও সম্ভব হয়ে উঠেছে। কাজেই পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, শিক্ষাগত রূপায়ণের ভাবী রূপ নিয়ে মুসলিম বাঙলার চিন্তানায়কদের মধ্যে এখন থেকেই আন্দোলন আলোচনা খুব স্বাভাবিকবাবেই শুরু হয়েছে।... পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্ৰীয় ও আর্থিক রূপায়ণ নিয়ে যথেষ্ট না হলেও অনেক আলোচনাই এরা করেছেন, আমরাও সে আলোচনায় অংশগ্রহণ করেছি। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা কি হবে, এ নিয়ে সোজাসুজি আলোচনা এঁরা আজো করেননি। করেননি বোধ হয় এই জন্য যে, পূর্ব পাকিস্তানের ‘জাতীয় দৈনিক আজাদ বাঙলা ভাষার কাগজ এবং এরাও তাই ধরে নিয়েছেন, পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা যে বাঙলা হবে, এ সত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েই আছে। হয়েই ছিল সত্য, বাঙলার মুসলমানদের মাতৃভাষা বাংলা হবে কি উর্দু হবে এ তর্ক খুব জোরেশোরেই একবার উঠেছিল। মুসলিম বাঙলার শক্তিশালী নেতাদের বেশীর ভাগ উর্দুর দিকে জোর দিয়েছিলেন, নবাব আবদুর রহমান মরহুম, স্যার আব্দুর রহিম, মোঃ ফজলুল হক, ডাঃ আবদুল্লাহ, সোহরাওয়াদী, মৌলভী আবুল কাসেম মরহুম প্রমুখ প্রভাবশালী নেতা উর্দুকে বাঙালী মুসলমানের মাতৃভাষা করবার প্রাণপণ চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু মুসলিম বাঙলার সৌভাগ্য এই যে, উর্দুর প্রতি যাদের বেশী সমর্থন থাকার কথা সেই আলেম সমাজই এই অপচেষ্টায় বাধা দিয়েছিলেন। বাঙলার আলেম সমাজের মাথার মণি মওলানা মোহাম্মদ আকরাম খাঁ, মওলানা আবদুল্লাহেল বাকী, মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামবাদী উর্দুবিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব করেছিলেন। এদের প্রয়াসে শক্তি যুগিয়েছিলেন মরহুম নবাব আলী চৌধুরী সাহেব। সে লড়াইএ এরাই জয়লাভ করেছিলেন। বাঙলার উপর উর্দু চাপাবার সে চেষ্টা তখনকার মত ব্যর্থ হয়। কিন্তু আদর্শের বুনিয়াদে পরিণত হওয়ায় উর্দুওয়ালারা আবার গা-ঝাড়া দিয়ে উঠেছেন। সম্প্রতি মর্নিং নিউজ’ ও ‘ষ্টার অব ইণ্ডিয়া এ ব্যাপারে কলম ধরেছেন। জনকতক প্রবন্ধ লেখকও তাতে জুটেছেন। এরা বলেছেনঃ “পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা স্বভাবতই উর্দু হবে।

 ১৩৫২ সালে (১৯৪৪) রচিত ও মাসিক মোহাম্মদীতে প্রকাশিত একটি ব্যঙ্গ কবিতায় ফররুখ আহমদ উর্দুপ্রেমিকদের প্রতি তীব্র কটাক্ষ ও বিদ্রুপবাণ হেনে লিখেছিলেনঃ

 
দুই শো পশ্চিম মুদ্রা যে অবধি হয়েছে বেতন
বাংলাকে তালাক দিয়ে উর্দুকেই করিয়াছি নিকা,
(বাপান্ত শ্রমের ফলে উড়েছে আশার চামচিকা)
উর্দুনীল আভিজাত্যে (জানে তা নিকট বন্ধুগণ)।
খাটি শরাফতি নিতে ধরিয়াছি যে অজানা বুলি
তার দাপে চমকাবে একসাথে বেয়ারা ও কুলি
সঠিক পশ্চিমী ধাঁচে যে মুহুর্তে করিব তর্জন।

পূর্ণ মোগলাই ভাব তোর সাথে দু’পুরুষ পরে
বাবরের বংশ দাবী-জানি তা অবশ্য সুকঠিন
কিন্তু কোন লাভ বল হাল ছেড়ে দিলে এ প্রহরে
আমার আবাদী গন্ধ নাকে পায় আজো অর্বাচীন।
নবাবী রক্তের ঝাজ আশা করি পাবে পুত্রগণ

(উর্দু বনাম বাংলা)