পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (প্রথম খণ্ড).pdf/৩৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ প্রথম খণ্ড
১২

 বিদ্যাভূষণ, শ্রীযুক্ত উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়, শ্রীযুক্ত অর্ধেন্দ্রকুমার গঙ্গোপাধ্যায়, শ্রীযুক্ত মন্মথ নাথ বসু ও শ্রীযুক্ত শৈলেন্দ্র কৃষ্ণ লাহা প্রমুখ।

 বাংলার রাষ্ট্রভাষা হইবার সম্ভাবনা সম্বন্ধে বক্তাদের মধ্যে একমাত্র অধ্যাপক সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় সন্দেহ প্রকাশ করেন। এইজন্য তাঁহার বক্তৃতার তাৎপর্য নীচে দেওয়া হইলঃ

 “ডঃ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করিবার সম্ভাবনা সম্বন্ধে সন্দেহ প্রকাশ করেন এবং বলেন যে, সাহিত্যের গৌরব থাকিলেই ভাষার প্রসার হয় না। ইংরেজ জাতির আত্মপ্রসারের শক্তির ফলে ইংরেজী ভাষার প্রসার হইয়াছে। কয়লাওয়ালা, চাউলওয়ালা, মুদী দারোয়ান প্রভৃতি নিম্ন শ্রেণীর লোকের কথাবার্তার ভিতর দিয়া হিন্দী ভাষার প্রসার ঘটিয়াছে। কিন্তু কংগ্রেস উহাকে রাষ্ট্রভাষা করিতে সাহসী নহে। কারণ মুসলমানেরা কিছুতেই উর্দু ছাড়িবে না। সেই জন্য হিন্দুস্থানীর সৃষ্টি হইয়াছে। হিন্দুস্থানী একাডেমী ও পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়ের চেষ্টায় অদ্ভুত হিন্দুস্থানী সৃষ্টি হইতেছে। তাহারা জোড়া জোড়া শব্দ ব্যবহার করিতেছে-একটি হিন্দু ও আর একটি উর্দু শব্দ। আন্তর্জাতিক শব্দটির শেষের নৈতিক’ শব্দের পরিবর্তে উর্দু কৌম’ শব্দ দিয়া তাহারা হিন্দুস্থানী ‘অন্তরাকৌম’ শব্দের সৃষ্টি করিয়াছে। এই ভাষা রাষ্ট্রীয় ভাষা হওয়ার সম্পূর্ণ অযোগ্য। বক্তা মনে করেন যে, বাঙালীদের এই সকল গোলমালে গিয়া কাজ নাই। কিন্তু যুক্ত প্রদেশ ও বিহারে বাংলা ভাষাকে দাবাইয়া রাখিবার যে চেষ্টা চলিয়াছে তাহার প্রতিবাদস্বরূপ বাংলাদেশেও হিন্দুস্থানী চালু করিবার চেষ্টার আপত্তি হওয়া উচিত। ডাঃ চট্টোপাধ্যায় আরও বলেন যে, গয়ার ভাষা ও মৈথিলী ভাষার সঙ্গে বাংলা ভাষার অনেক মিল আছে, কিন্তু লিখিবার সময় সেখানকার হিন্দুরা হিন্দী ও মুসলমানেরা উর্দু ভাষা ব্যবহার করে। প্রকৃতপক্ষে উর্দু ও হিন্দী ভাষা ছাড়া ভারতের সব ভাষার গতি ও প্রকৃতি এক। কারণ গঙ্গা ও যমুনার মধ্যবর্তী প্রদেশ হইতে যে ভাষার সৃষ্টি হইয়াছে তাহাই ভারতের সর্বত্র ছড়াইয়া পড়িয়াছে।

 “বাংলার স্বাতন্ত্র্যের এই ধ্যান-ধারণার ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তান রেনেসাঁ সোসাইটি গঠিত হয়েছিল। রেনেসাঁ আন্দোলনের উদ্দেশ্য, লক্ষ্য এবং চারিত্র্য সম্পর্কে ১৯৪২ সালে বলা হয়েছিলঃ

 “পূর্ব পাকিস্তান রেনেসা ঁসোসাইটি চায় পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসীর বুদ্ধির মুক্তি তার চিন্তারাজ্যে অরাজকতার অবসান[১] আপনারা নিশ্চয়ই একথা অস্বীকার করবেন না যে, বুদ্ধির মুক্তি না ঘটলে এবং চিন্তারাজ্যের অরাজকতার অবসান না হলে, মানে আভ্যন্তরীণ মুক্তি না ঘটলে কোন জাতির বহিরাঙ্গিক মুক্তিও সাধিত হয় না। তাই পূর্ব পাকিস্তানের বহিরাঙ্গিক মুক্তি, মানে রাজনৈতিক আজাদী সত্যিকারভাবে আসতে পারে না। ততক্ষণ, যতক্ষণ না তার অধিবাসীর মনের মুক্তি, মানে চিন্তারাজ্যের অরাজকতা দূর হচ্ছে।

 আমাদের সোসাইটি জাতির এই মনের মুক্তি আনবারই সাধনা করছে। এই যে মনের মুক্তি, এ হচ্ছে রেনেসাঁর ব্যাপার। জাতির চিন্তারাজ্যে বিপ্লবাত্মক পরিবর্তন সংঘনের নাম রেনেসাঁ। অতীতে প্রত্যাবর্তনের নাম রেনেসাঁ নয়, আবার অতীতকে সমূলে বর্জন করার কল্পনাও রেনেসাঁর নেই। অতীতের যা ভালো ও স্থায়ী তাই ভবিষ্যতকে বরণ করে। তাই রেনেসাঁ চিন্তারাজ্যের বিপ্লব। আমরা পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) অধিবাসীর চিন্তারাজ্যে এই বিপ্লবাত্মক পরিবর্তনই চাই। তাই আমাদের সঙ্ঘের নাম ‘পূর্ব পাকিস্তান রেনেসাঁ সোসাইটি’। জাতির রাজনৈতিক মুক্তির সর্বাঙ্গীণ জাতীয় আজাদী নয়। কাজেই জাতির রাজনৈতিক মনের মুক্তি বিজ্ঞানসম্মত পন্থা-নির্দেশই রেনেসাঁর একমাত্র কাজ নয়। তামদুনিক, সাহিত্যিক, আর্থিক, শৈক্ষিক মুক্তি না ঘটলে শুধু রাজনৈতিক আজাদী লাভ করে কোনো জাতি সত্যিকার আজাদী লাভের অধিকারী হয় না। রেনেসাঁ


  1. বিভাগ পূর্বকালেই ধরে নেয়া হয়েছিল যে ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব বাস্তবায়িত হলে “পূর্ব পাকিস্তান” হবে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে ভিতর দিয়ে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সত্তা ও স্বাধীন সার্বভৌম অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।