পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (প্রথম খণ্ড).pdf/৩৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ প্রথম খণ্ড
১৩

 তাই সাহিত্য, তমদ্দুন, শিা, অর্থনীতি, শিল্প প্রভৃতি সম্পর্কেও জাতিকে বিপ্লবাত্মক পরিবর্তনে উদ্বুদ্ধ করে।. পলাশীর বিপর্যয়ের পরে ভারতের এই পূর্বাঞ্চলের অধিবাসীদের রাজনৈতিক চিন্তাধারা এ যাবৎ ভুল পথেই প্রবাহিত হয়ে এসেছে। প্রথমে আমরা অতীতে প্রত্যাবর্তনের উৎকট প্রয়াস করেছিলাম। আমাদের সে চেষ্টা স্বাভাবিকভাবেই ব্যর্থ হয়েছে। কারণ অতীতে প্রত্যাবর্তনের বাণী সত্যকার আজাদীর কথা- রেনেসাঁর কথা নয়। সে ব্যর্থতার পরে আমরা গ্রহণ করেছিলাম অনুকরণের পথ। পরের দেখানো পথে আজাদী মেলে না। আমরা ভুল পথে গিয়ে লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে পড়েছিলাম। এই সব ব্যর্থতার অভিজ্ঞতা জাতিকে দিয়েছে সত্যিকার পথের সন্ধান। জাতির চিত্তলোক ফুড়ে উত্থিত হয়েছে পাকিস্তানের বাণী।[১] একমুহুর্তে জাতি আপন স্বচ্ছতা ফিরে পেয়েছে- পুরানুকরণের আলেয়ার পশ্চাদ্ধাবন ত্যাগ করে সে স্বকীয়তাকে বরণ করেছে। সাহিত্যেও প্রায় একই ব্যাপারে অনুষ্ঠিত হয়েছে। ভাষার মোহে কাটিয়েছি। তারপর শুরু হ’ল অনুকরণের পালা। সে অদ্ভুত কসরৎ এখনো চলছে। তবে সে কসরতের হাস্যকরতার উপলব্ধি ধীরে ধীরে আমাদের মধ্যে হচ্ছে। পূর্ব-পাকিস্তান রেনেসাঁ-সোসাইটি আমাদের সাহিত্যে স্বচ্ছতা ও স্বকীয়তা আসবে না- কারণ ওটা অতীতে প্রত্যাবর্তনেরই কথা-রেনেসাঁর কথা নয়। তবে পুথি ও লোক-সাহিত্যের ভিত্তিতে আমাদের সাহিত্যকে দাঁড় করাতে হবে নিশ্চয়ই। সে ভিত্তির উপর বর্তমানের ব্যর্থ হবে। তমদ্দুন, শিক্ষা, ইতিহাস, অর্থনীতি প্রভৃতি ক্ষেত্রেও (সাবেক) পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসীর স্বকীয় বিশিষ্টতাকে খুঁজে বার করতে হবে-তাকে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। পলাশীর বিপর্যয়ে জাতি হিসাবে জীবন্মত হয়ে গিয়েছিলাম আমাদের তামদুনিক বৈশিষ্ট্যের কথা, ভুলেছিলাম আমাদের শিক্ষানীতির গণতান্ত্রিক এবং অর্থনীতি সমাজতান্ত্রিক ভিত্তির বিশিষ্টতার কথা। এসব ক্ষেত্রেও আমরা স্বকীয়তা হারিয়ে অনুকরণের বাঁদরে পরিণত হয়েছিলাম। কাজেই রেনেসাঁর সোনার কাঠির স্পর্শে আমাদের এ বাঁদরত্ব ঘোচাতে হবে।”

[আবুল কালাম শামসুদ্দীন, রেনেসা ঁসম্মেলনে অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতির ভাষণ, মাসিক মোহাম্মদী, শ্রাবণ ও ভাদ্র, ১৩৫১।]

 দেশ বিভাগ এবং সাবেক পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার অনেক আগেই পূর্ব পাকিস্তান রেনেসাঁ সোসাইটির উদ্যোগে আয়োজিত ১৩৫১ সালে কলিকাতায় অনুষ্ঠিত রেনেসাঁ-সম্মেলনে মূল সভাপতির অভিভাষণ দিতে গিয়ে প্রখ্যাত সাহিত্যিক আবুল মনসুর আহমদ স্পষ্টতই বলেছিলেন:

 “রাজনীতিকের বিচার (সাবেক) পাকিস্তানের অর্থ যাই হোক না কেন সাহিত্যিকের কাছে তার অর্থ তমদ্দুনী আজাদী, সাংস্কৃতিক স্বরাজ, কালচারে অটনমী। রাজনৈতিক আজাদী ছাড়া কোনো জাতি বাঁচতে পারে কিনা সে প্রশ্নের জবাব পাবেন আপনারা রাষ্ট্র নেতাদের কাছে। আমরা সাহিত্যিকরা শুধু এই কথাটাই বলতে পারি যে, তমদ্দুনী আজাদী ছাড়া কোনো সাহিত্য-বাঁচাতো পরের কথা-জন্মাতেই পারে না। -পাকিস্তান (সাবেক) ও একটা বিপ্লব। এ বিপ্লব আনতে হলে সাহিত্যের ভেতর দিয়েই তা করতে হবে। কিন্তু কোথায় পাকিস্তানের সাহিত্য? (সাবেক) পূর্ব পাকিস্তান অর্থাৎ বাংলা ও আসামের সাহিত্য বলতে আমরা যা বুঝি, তা বিদ্যাসাগর- বঙ্কিমচন্দ্র থেকে রবীন্দ্র-শরৎচন্দ্র যুগের সাহিত্যিকদের সাহিত্য। এটা খুবই উন্নত সাহিত্য। বিশেষতঃ রবীন্দ্রনাথ এসাহিত্যকে বিশ্ব-সাহিত্যের দরবারে স্থান দিয়ে গিয়েছিলেন। তবুও এ-সাহিত্য পূর্ব পাকিস্তানের সাহিত্য নয়। এসাহিত্যে মুসলমানদের উল্লেখযোগ্য কোনো দান নেই। শুধু তা নয়, মুসলমানদের প্রতিও এ-সাহিত্যের কোনো দান নেই। অর্থাৎ এ সাহিত্য থেকে মুসলিম সমাজ-প্রাণ প্রেরণা পায়নি এবং পাচ্ছে না। এর কারণ


  1. ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব ও তৎকালীন 'পাকিস্তান পরিকল্পনা' অনুযায়ী “পূর্ব পাকিস্তান” স্বতন্ত্র, সার্বভৌম ও স্বাধীন রাষ্ট্র হবে। এটাও ছিল নিশ্চিত।