পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (প্রথম খণ্ড).pdf/৪০৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ প্রথম খন্ড

 অদ্যাবধি পূর্ব পাকিস্তানে একটিও সরকারী পাঠাগার বা ষ্টেট লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠিত হয় নাই। স্মরণ রাখিতে হইবে যে সারা পাকিস্তানের শতকরা ৫৬ ভাগ লোক পূর্ব পাকিস্তানে বাস করে।

 স্ত্রী শিক্ষার জন্য একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ কলেজ ও আধুনিক ছাত্রীনিবাস পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানীতে নাই। মহিলাদের কলেজ ও ছাত্রী নিবাসের জন্য বিরাট ইমারত প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল তাহা লীগ মন্ত্রিসভা নির্লজ্জের মত সেক্রেটারিয়েট ভবন হিসাবে ব্যবহার করিতেছেন।

 সরকারী বালিকা বিদ্যালয়গুলিতেও আত্মীয় পোষণ নীতি অনুসারে উজিরদের আত্মীয়স্বজনকে রাখা হইয়াছে। তাহার ফলে শিক্ষার মান যথেষ্ট কমিয়া গিয়াছে। ইহার উপর ছাত্রীদের বাসের ভাড়া ও বেতন বৃদ্ধি করিয়া বহু ছাত্রীকে পড়া ত্যাগে বাধ্য করা হইয়াছে।

 শিক্ষাক্ষেত্রে দুর্নীতি এত ব্যাপকভাবে দেখা দিয়াছে যে পুস্তক নির্বাচন কমিটি ঘুষ ছাড়া কথা বলে না। অর্থ ব্যয় করিয়া অনেক অপাঠ্য পুস্তক করা যায় এ কথা পূর্ব পাকিস্তানের লীগ ওজারতের আমলেই সত্য বলিয়া প্রমাণিত হইল।

 পূর্ব্ব-পাকিস্তানের শিক্ষা উন্নয়নের জন্য ১৯৪৭ সালে শিক্ষা পুনর্গঠন কমিটি সুপারিশ করিয়াছিলেন যে প্রাথমিক স্তরে মাতৃভাষা ছাড়া অন্য কোন ভাষায় শিক্ষা দেওয়া হইবে না। কিন্তু বিদ্যাদিগগজ মন্ত্রীরা প্রাথমিক স্তরে উর্দ্দু ভাষাকে এদেশে বাধ্যতামূলক করিয়া প্রাথমিক শিক্ষার চরম সর্ব্বনাশ সাধন করিয়াছেন। পূর্ব্ব বঙ্গের প্রথমিক শিক্ষার জন্য কেন্দ্র হইতে বৎসরে ৫২ লক্ষ টাকা দেওয়ার কথা ছিল, কিন্তু সে কথা রক্ষিত হয় নাই। এবং পূর্ব্ব বঙ্গের অযোগ্য মন্ত্রীরা উহা আদায় করিতে পারেন নাই।

 ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ঋণগ্রস্ত থাকা সত্ত্বেও প্রথম কয়েক বৎসর কেন্দ্রের নিকট সাহায্য চাহিয়া বিফল মনোরথ হইয়াছে, অথচ সিন্ধুতে বিশ্ববিদ্যালয় থাকা সত্ত্বেও করাচীর জন্য আবার একটি ফেডারেল ইউনিভারসিটি করা হইয়াছে।

 এদেশের দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সমত্মানরা যখন অর্থাভাব এবং সরকারী অব্যবস্থায় শিক্ষা লাভে বঞ্চিত হইতে চলিয়াছে, তখন ধনী এবং কায়েমী স্বার্থবাদীদের সমত্মানরা ইংরেজী ভাষার মাধ্যমে শিক্ষার জন্য পাবলিক স্কুল প্রতিষ্ঠিত হইতেছে। এক ভিকারুন্নিসা স্কুলেরর জন্যই সরকার এ পর্য্যন্ত ৩০ লক্ষ টাকা ব্যয় করিয়াছেন। এই স্কুল তৃতীয় শ্রেণীর একটি ছাত্রীর বেতন ১৫।০ আনা। এই ব্যয়বহুল শিক্ষার কারণ সম্পর্কে মন্ত্রীরা বলেন যে এদেশের শাসক তৈয়ারীর জন্য এই ধরনের স্কুলের প্রয়োজন আছে। ইসলামী হুকুমতে শাসক ও শাসিত সম্প্রদায় সৃষ্টির বাসনা অত্যন্ত মারাত্মক। ইহাকে গায়েব ইসলামী কাণ্ড-কারখানা বলা যাইতে পারে।

 পূর্ব্ব বাংলায় সরকারী ও বেসরকারী স্কুলের পার্থক্য বজায় রাখিয়া শিক্ষার প্রসারের মূলে কুঠারাঘাত করা হইয়াছে। পূর্ব্ব-বাংলার মোট আদায়ী রাজস্ব ২৭ কোটি টাকার মধ্যে সাড়ে ১৩ কোটি টাকা সিভিল ও পুলিশ খাতে ব্যয় হয়। আর সরকারী স্কুল ও কলেজে যে খরচ করা হয়, তাহার অর্ধেকও বেসরকারী স্কুল ও কলেজের জন্য খরচ করা হয় না।

জমিদারী প্রথা বিলোপের ভাঁওতা

 মুসলিম লীগ যখন পাকিস্তান আন্দোলন আরম্ভ করিয়াছিল, তখন জনগণের নিকট ইহার অন্যতম প্রতিশ্রুতি ছিল এই যে বিনা খেসারতে জমিদারী দখল করিয়া ভূমিহীন চাষীদের মধ্যে উহা বিতরণ করা হইবে। কিন্তু পাকিস্তার প্রতিষ্ঠার পর কায়েমী স্বার্থে দালালরূপে মুসলিম লীগ ৬০ কোটি টাকা খেসারত দিয় জমিদারী খরিদ করিল। এই টাকা যতদিন না শোধ হয়, ততদিন চক্রবৃদ্ধি হারে জমিদারকে সুদ দিতে হইবে। ইহাতে প্রায় ১২৫ কোটি টাকা মোট ক্ষতিপূরণ দিতে হইবে।