পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (প্রথম খণ্ড).pdf/৪০৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ প্রথম খন্ড
৩৮৩

 জমিদারী ইতিহাস পর্যালোচনা করিলে দেখা যায় যে অনেক জমিদারীর নামমাত্র মূল্যে অথবা বিনা মূল্যে বৃটিশ শাসকের নিকট হইতে দেশদ্রোহিতার এনাম-স্বরূপ জমিদারী পাইয়াছিল। ইহারা হেষ্টিংসের আমল হইতে নাজিমুদ্দিনের আমল পর্যন্ত প্রজাদের নির্ম্মমভাবে শোষণ করিয়া নিজেরা ভোগ বিলাসের মত্ত থাকিত। ইহাদিগকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কোন সঙ্গত কারণ থাকিতে পারে না, কিন্তু যেহেতু মুসলিম লীগ তাহার ঐতিহ্য ভুলিয়া জমিদার ও মহাজনের খবরদারী আরম্ভ করিয়াছে, সেহেতু পূর্ব্ব পাকিস্তানের জনগণের কষ্টার্জিত অর্থ দ্বারা জমিদারদের ক্ষতিপূরণ দিতেছে। কাহারও সম্মত্তি বিনা খেসারতে জোর করিয়া ছিনাইয়া লওয়া ইসলাম বিরোধী, এইরূপ হাস্যকর যুক্তি তাহারা দিতেছেন।

পাট কেলেঙ্কারী

 দুনিয়ায় যত পাট উৎপন্ন হয়, তাহার শতকরা ৭৫ ভাগ পূর্ব্ব বাংলায় জন্মে। কিন্তু চাষীরা যেমন পাট উৎপাদন করিয়া তাহাদের ক্ষুধার অন্ন পায় না, তেমনি পাট ব্যবসায়ী যদি পূর্ব্ব পাকিস্তানী হয়, তাহারও অন্ন জোটা দায়। সাবেক বাণিজ্য মন্ত্রী ফজলুর রহমানের ষড়যন্ত্রে মাত্র ১৪টি কোম্পানী বিদেশে পাট চালান দেওয়ার অধিকার লাভ করিয়াছিল। তাহাদের মধ্যে মাত্র ১টি পূর্ব্ব পাকিস্তানী প্রতিষ্ঠান।

 চাষীদের অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয় হইয়াছে লীগ সরকারের ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রের ফলে। যখন পাট বাজারে উঠে, তখন সুকৌশলে বিদেশী ব্যবসায়ীরা পাট ক্রয় বন্ধ রাখে। ফলে যে এক মন পাট উৎপাদন করিতে চাষীর ১৯.০০ টাকা খরচ লাগে, সেই পাট তাজাকে ৩.০০ টাকা মন দরেও বিক্রয় করিতে হয়। অথচ যখনই সেই পাটচাষীর হাতছাড়া হইয়া ইস্পাহানী, আদমজী, রালী ব্রাদার্স প্রমুখ বড় বড় পুঁজিপতি ব্যবসায়ীদের হাতে গিয়া পড়ে তখনই পাটের দাম কমপক্ষে ৪০/৪৫ টাকা ওঠে। চাষীর এই অবস্থার সঙ্গে ইষ্ট-ইণ্ডিয়া কোম্পানীর আমলের নীল চাষীদের দুর্ভাগ্যের তুলনা করা যায়। নীলের ব্যবসায়ে বিদেশী বণিকেরা ধনকুবের হইত, আর দেশী চাষীরা শ্মশান-গোরস্তানের প্রতীক্ষা করিত। চাষীগণকে বাঁচাইবার ইচ্ছা যদি লীগ সরকারের থাকিত, তাহা হইলে পাট ব্যবসায় জাতীয়করণ করা হইত। কিন্তু কায়েমী স্বার্থের দালাল বলিয়া মুসলিম লীগ গণস্বার্থের খবরদারী করিতে পারে না। গণ দরদী দেশনায়কবৃন্দের যুক্তফ্রণ্টের নির্বাচনী ওয়াদার অন্যতম প্রধান ওয়াদা হইতেছে পাট ব্যবসায়কে জাতীয়করণের ওয়াদা।

করভার পীড়িত দরিদ্র চাষী

 পাটের চাষ করিয়া যে চাষী সর্ব্বস্বান্ত হইয়াছে, তাহার উপর যদি আরও করভার চাপাইয়া দেওয়া হয়, তাহা হইলে তাহার বাঁচিবার আশা কোথায়? চাষের ফসলে হইতে পয়সা পায় না, দুই চারিটি সুপারী গাছ আছে, সেই সুপারী বিক্রয় করিয়া হয়তো তাহার কয়েকদিন গুজরান হইতে পারে, কিন্তু তাহাও লীগ সরকারের সহ্য হইল না। সরকার চাষীর উপর সুপারী কর ধার্য্য করিলেন। এই কর তিন প্রকারে আদায় হইতেছে। প্রথমতঃ প্রতি সুপারীগাছে দু-আনা, প্রতি কুড়ি সুপারীর উপর ছয় পয়সা ও প্রতি মণে ১০ টাকা ২ আনা কর দিতে হয়।

 গরীবের উপায়ের আর একটি পথ তামাক বিক্রয়। কিন্তু তাহার উপরও ট্যাক্স ধার্য্য করা হইয়াছে। চাষী তার ক্ষেতে উৎপাদিত তামাকের উপর প্রতি সের ১২ আনা, প্রতি মণে ৩০ টাকা ১৪ আনা ট্যাক্স দিতেছে। ইহার উপর লাইসেন্সের ঝামেলা তো আছেই। বিনা লাইসেন্সে তামাক বিক্রয় করা যায় না অথচ লাইসেন্স লইতে গেলেও চাষীকে অর্থ ব্যয় করিতে হয়। ১৫০-৫১ সালের হিসাবে দেখা যায় যে ঐ বৎসরে রংপুরে প্রতি মণ তামাক ৪০ টাকা ৮ আনা হইতে ৪০ টাকা মন দরে বিক্রয় হইয়াছিল, কিন্তু চাষীরা পাইয়াছিল খরচা সমেত মাত্র ১০ টাকা ৮ আনা।

 পূর্ব্ব পাকিস্তানে নওগাঁ গাঁজা উৎপাদনের কেন্দ্র। এই গাঁজার পয়সায় চাষীরা সুখে কালাতিপাত করিতেছিল। কিন্তু মুসলিম লীগ সরকার গাঁজার প্রতিসেরে ৬৩। আনা ট্যাক্স বসাইয়া দেন। ইহার ফলে