পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (প্রথম খণ্ড).pdf/৪১৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ প্রথম খন্ড
৩৯৩

 “কিছুদিন থেকে বানান ও অক্ষর সমস্যা দেশে দেখা দিয়েছে। সংস্কারমুক্তভাবে এগুলির আলোচনা করা উচিত এবং তার জন্য বিশেষজ্ঞদের নিয়ে পরামর্শ সমিতি গঠন করা আবশ্যক। যারা ধ্বনিতত্ত্বের সংবাদ রাখেন, তাঁরা স্বীকার করতে বাধ্য যে বাংলা বানান অনেকটা অবৈজ্ঞানিক, সুতরাং তার সংস্কার দরকার। কেউ কেউ আরবী হরফে বাংলা লিখতে উপদেশ দিয়েছেন। যদি পূর্ব্ব বাংলার বাইরে বাংলাদেশ না থাক্ত আর যদি গোটা বাংলাদেশে মুসলমান ভিন্ন অন্য সম্প্রদায় না থাকত তবে এই অক্ষরের প্রশ্নটা এত সঙ্গীন হত না। আমাদের বাংলাভাষী প্রতিবেশী রাষ্ট্র ও সম্প্রদায়ের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে হবে। কাজেই বাংলা অক্ষর ছাড়তে পারা যায় না। আরবী হরফে বাংলা লিখলে বাংলার বিরাট সাহিত্য ভাণ্ডার থেকে আমাদিগকে বঞ্চিত হতে হবে। অধিকন্তু আরবীতে এতগুলি নূতন অক্ষর ও স্বরচিহ্ন যোগ করতে হবে যে বাংলার বাইরে তা কেউ অনায়াসে পড়তে পারবে না।

 “বিদেশীর জন্য অক্ষর জ্ঞানের পূর্ব্বে ভাষাজ্ঞান এমন অদভুত কল্পনা এ বৈজ্ঞানিক যুগে খাটে না। অক্ষর সম্বন্ধে বিবেচনা করতে হলে ছাপাখানা, টাইপ-রাইটার, শটহ্যাণ্ড এবং টেলিগ্রাফের সুবিধা অসুবিধার কথা মনে রাখতে হবে। বিশেষ করে বাংলাকে যখন পাকিস্তানে রাষ্ট্রভাষারূপে গ্রহণ করা হচ্ছে তখন বাংলা ভাষার রাজনৈতিক সম্ভাবনা ও উপযোগিতার কথা চিমত্মা করারও প্রয়োজন রয়েছে। জনসাধারণের মধ্যে শিক্ষা ও জ্ঞান বিস্তারের জন্য Basic English এর মত এক সোজা বাংলার বিষয় আমাদের বিবেচনা করা কর্ত্তব্য। যদি ৮৫০টি ইংরেজী কথায় সমস্ত প্রয়েজনীয় ভাব প্রকাশ করতে পারা যায়, তবে বাংলায় তা কেন সম্ভব নয়?

 পূর্ব্ব বাংলার জনসংখ্যা গ্রেটব্রিটেন, ফ্রান্স, ইতালী, স্পেন, পর্ত্তুগাল, আরব, পারস্য, তুর্কি প্রভৃতি দেশের চেয়ে বেশী। এই সোনার বাংলাকে কেবল জনে নয়, ধনে-ধ্যান্যে, জ্ঞানে-গুনে, শিল্প-বিজ্ঞানে পৃথিবীর যে কোন সত্য দেশের সমকক্ষ হতে হবে। তাই কেবল কাব্য ও উপন্যাসের ক্ষেত্রে বাংলাকে সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না। দর্শন, ইতিহাস, ভূগোল, গণিত, পদার্থবিদ্যা, ভূতত্ত্ব, ভাষাতত্ত্ব, অর্থনীতি, মনোবিজ্ঞান, প্রত্নতত্ত্ব, প্রভৃতি জ্ঞান বিজ্ঞানের সকল বিভাগে বাংলাদে উচ্চ আসন নিতে ও দিতে হবে। তার জন্য শিক্ষার মাধ্যম স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে আগাগোড়া বাংলা করতে হবে।

 আমি অষ্টাদশ শতাব্দীর কবি ‘নুরনামার’ লেখক নোয়াখালী সন্দ্বীপ নিবাসী আব্দুস হাকিমের একটি কথা আমাদের দেশের এক শ্রেণীর লোককে শুনিয়ে রাখছি:

“যে সবে বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী।
সে সবার কিবা রীতি নির্ণয় না জানি॥
মাতা পিতাময় ক্রমে বঙ্গেতে বসতি।
দেশী ভাষা উপদেশ মনে হিত অতি॥
দেশী ভাষা বিদ্যা যার মনে না জুয়ায়।
নিজ দেশ তেয়াগি কেন বিদেশে না যায়॥”

 সাহিত্যিক বন্ধুগণ, আমি পুরানো হয়েছি, আমার কথাও পুরানো হয়েছে। কিন্তু আমার সব কথা এখনও শেষ হয়নি। কিন্তু উদ্বোধনী বক্তৃতার সীমা লংঘন করে আপনাদের ধৈর্য্যের উপর অত্যাচার করতে চাই না, তাই করুণাময় আল্লাহ তায়ালার নিকট বাঙ্গালা সাহিত্যের উন্নতি এবং এই সাহিত্য সম্মেলনের সাফল্যপূর্ণ ও শান্তিময় পরিসমাপ্তি কামনা ক’রে এর শুভ উদ্বোধন ঘোষণা করছি।

“আল্লাহুমা-ফতাহ্ লনা আবওয়াবি রহমতিক”

হে আল্লাহ্ আমাদের জন্য দয়ার দ্বার উন্মুক্ত কর।

বাংলা ভাষা জিন্দাবাদ

পাকিস্তান জিন্দাবাদ