পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (প্রথম খণ্ড).pdf/৪৩৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ প্রথম খন্ড
৪১১

 যুক্তফ্রণ্ট মন্ত্রিসভা ডিসমিস করিবার পর হইতে আজ পর্যন্ত দশ মাসের বেশী সময় চলিয়া গিয়াছে আমরা এবং আমাদের দেশবাসী তদবধি শামিত্ব পূর্ণমাত্রায় বিরাজ রাখিয়া চলিয়াছি উচ্চপদস্থ সরকারী লোকেরাও এ কথা বহুবার স্বীকার করিয়াছেন। কোথাও কোন গোলমাল বা কোন জরুরী অবস্থা আদৌ দেখা দেয় নাই, তথাপি ৯২ (ক) ধারা শাসনের অবসান হইতেছে না, জনগণের শাসন জনপ্রতিনিধিদের হাতে ফিরাইয়া দেওয়া হইতেছে না। কিছুদিন যাবৎ যুক্তফ্রণ্ট দলের ভিতর বিভেদের অজুহাত দেখাইয়া গণ-শাসনকে দাবাইয়া রাখার প্রচেষ্টা চলিয়াছে। অল্পবিস্তর মতান্তর সব দেশে সব পার্টিতেই থাকে কিন্তু উক্তরূপ মতান্তরের অজুহাতে কোন স্বাধীন দেশে কোনকালে পার্লামেণ্টারী শাসন আটকাইয়া রাখার রীতি নাই। ইউরোপীয় বহু দেশে কোন দলের যথোযুক্ত সংখ্যাগরিষ্ঠতার অভাবেই মন্ত্রিসভা পুনঃ পুনঃ ভাঙ্গাগড়া হইয়া থাকে কিন্তু তথাপি ঐ অজুহাতে পার্লামেণ্টারী শাসন হইতে দেশবাসীকে বহির্গত করা হয় না। কোন কোন মহল হইতে সংবাদপত্রে প্রকাশ করা হইয়ায়ে আমি কেন্দ্রীয় সরকারের নিকট গ্রহণযোগ্য নই বলিয়া এখানে পার্লামেণ্টারী শাসন প্রবর্তন সম্ভব হইতেছে না। এইরূপ অহেতুক উক্তির তাৎপর্য আমি বুঝিতে অক্ষম। কেন্দ্রীয় সরকার বা তাহার নিয়োজিত প্রাদেশিক গভর্ণর যাহাকে আইন পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের আস্থাভাজন বলিয়া মনে করিবেন তাহাকেই আইনানুসারে মন্ত্রিসভা গঠন করার জন্য আবেদন করিতে পারেন সুতরাং কোন ব্যক্তি গ্রহণযোগ্য বা কোন ব্যক্তি গ্রহণযোগ্য নয় ইহা যাচাই করার গভর্ণরের নিকট একমাত্র মাপকাঠি হইতেছে পরিষদ সভ্যদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা। নির্বাচনের প্রাক্কালে আমি পূর্ব বাংলার সর্ব্বত্র ঘুরিয়া ঘোষণা করিয়াছিলাম। যে যুক্তফ্রণ্ট দলের সভ্যদের ভোট দেওয়া হইলে সেই ভোট আমাকেই দেওয়া হইবে। দেশবাসী আমার সেই আহ্বানে আশাতীত সাড়া দিয়াছিলেন, সুতরাং আমার দেশবাসী আমাকে ত্যাগ না করা পর্য্যন্ত আমি তাহাদিগকে ন্যায়তঃ ও ধর্মতঃ ত্যাগ করিতে পারি না। কিন্তু তাই বলিয়া আমার জন্য পার্লামেণ্টারী শাসন আটকিয়া থাকার কোনই কারণ নাই। প্রাদেশিক গভর্ণর যদি মনে করেন আমাকে ছাড়া অন্য কেহকে দিয়া জনগণের ও পরিষদের গরিষ্ঠসংখ্যক সভ্যদের আস্থাভাজন কোন মন্ত্রিসভা গঠন করা সম্ভব তিনি বিলক্ষণ তাহা করিতে পারেন। আমি আজ এই প্রকাশ্য সভায় ঘোষণা করিতেছি যে আমি চাই জনগণের আস্থাভাজন পার্লামেণ্টারী শাসন কোন ব্যক্তির জন্য তাহা রহিত হইয়া থাকিতে পারে না কারণ ব্যক্তি চেয়ে দেশ ও জাতি অনেক বড়। যে যুক্তফ্রণ্ট দল শতকরা সাতান্নববইটি ভোট পাইয়া জয়ী হইয়াছে সেই দলকে তথা সাড়ে চারি কোটি পূর্বপাকিস্তান বাসীকে তাহাদের জন্মগত গণতান্ত্রিক শাসনাধীকার হইতে বঞ্চিত করিয়া রাখার কোন অধিকার কোন সরকারের বা কেহরই নাই।

 এতক্ষনে শুধু পার্লামেণ্টারী শাসনের কথা আমি বলিয়াছি এখন উহা হইতেও গুরুতর একটি বিষয়ের কথা আপনাদিগকে বলিব। আপনার জানেন গত বৎসর ২৪শে অক্টোবর তারিখে পাকিস্তানের গভর্ণর জেনারেল একটি ঘোষণা দ্বারা গণপরিষদ বাতিল করিয়া দিয়া উক্ত ঘোষণায় বলিয়াছিলেন যে জনগণই সকল ক্ষমতার অধিকারী এবং জনগণের ইচ্ছানুসারেই সব কিছু করা হইবে। সারা দেশের লোক গভর্নর জেনারেলের উপরোক্ত ঘোষণা শুনিয়া বড়ই আশান্বিত হইয়াছিল। গত ১০ই মার্চ্চ তারিখে পাকিস্তান ফেডারেল কোর্টে জনাব তমিজদ্দিন খার মামলা পরিচালনার সময় কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়োজিত কৌসুলি মিঃ ডিমপলক আদালতের নিকট উক্ত সরকারের নির্দ্দেশানুসারে নিবেদন করিয়াছিলেন যে গভর্ণর জেনারেল বর্ত্তমান প্রাদেশিক আইন পরিষদগুলির মাধ্যমে নির্ব্বাচনের সাহায্যে একটি নূতন গণপরিষদ গঠন করিতে ইচ্ছুক রহিয়াছেন। কিন্তু সাম্প্রতিক কতগুলি ঘটনাপ্রবাহের ফলে জনগণ উদ্বিগ্ন ও আশঙ্কিত হইয়া পড়িয়াছে। কিন্তু উদ্বেগ ও আশঙ্কার কারণ এই যে ইদানীং সরকার সভ্য মনোনয়ন দ্বারা একটি শাসনতন্ত্র রচনাকারী কমিটি গঠন করিতে চান বলিয়া বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশ পাইয়াছে, আবার এমন কথাও শুনা যাইতেছে যে অর্ডিন্যাসের সাহায্যেও সরাসরি একটি শাসনতন্ত্র জারী করা সম্ভব। এইভাবে জনগণের সম্মতি ব্যতিরেকে যদি কোন শাসনতন্ত্র রচনাকরী কমিটি গঠন করতঃ উহার সাহায্যে বা সরাসরি কোন অর্ডিন্যান্স জারী করিয়া কোন শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করা হয় তাহা হইলে উহা দ্বারা স্বাধীনতার মূলনীতিকেই অস্বীকার করা হইবে এবং উহা কিছুতেই জনগণের গ্রহণযোগ্য হইবে না।

 উপরোক্ত দুইটি বিষয়ে বিশেষ উৎকণ্ঠিত হইয়া মানুষের জন্মগত নাগরিক গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার উদ্দেশ্যে আমি অদ্যকার দিবসটি ঘোষণা করতঃ আমার দেশবাসীকে যথাযথভাবে ইহা প্রতিপালন করিবার অনুরোধ জানাইয়াছি। গভর্ণর জেনারেলের ২৪শে অক্টোবর ঘোষণার ভাষায় চূড়ান্ত ক্ষমতায় অধিকারী আপনারা