পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (প্রথম খণ্ড).pdf/৪৬৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ প্রথম খন্ড
888
শিরোনাম সূত্র তারিখ
বাংলা একাডেমীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আবু হোসেন সরকারের ভাষণ পাকিস্তান সরকার ডিসেম্বর, ১৯৫৫

বাংলা একাডেমীর উদ্বোধীন অনুষ্ঠানে

উজীরে আলা

জনাব আবু হোসেন সরকারের

ভাষণ

সমাগত সুধীজন,

 একুশ দফা কার্যসূচীতে পূর্ববাংলার জনগণের কাছে আমরা যে সব প্রতিজ্ঞা করিয়াছিলাম, আজ তাহারই একটি ওয়াদা পালনের জন্য আমরা এখানে সমবেত হইয়াছি। সাড়ে চার কোটি পূর্ববঙ্গবাসীর মাতৃভাষা বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা এবং তাহাকে উপযুক্ত মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করার যে সার্বজনীন দাবী, মূলতঃ তাহা হইতেই বাংলা একাডেমী প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা জন্ম লইয়াছে। কাজেই বাংলা একাডেমী প্রতিষ্ঠা পূর্ব বাংলার ভাষার শাশ্বত দাবী ও ঐতিহাসিক আন্দোলনেরই প্রথম বাস্তব স্বীকৃতি। যাঁহাদের মহান ত্যাগে এই দাবী প্রতিরোধ্য হইয়া উঠিয়াছে, আজিকর এই দিনে সকলের আগে আমরা তাঁহাদের স্মরণ করিতেছি শ্রদ্ধাবনত চিত্তে। বাংলা একাডেমী স্থাপনের উদ্যোগ-আয়োজন আমাদের প্রথম যুক্তফ্রণ্ট সরকার ক্ষমতালাভের অব্যবহিত পরেই করিয়াছিলেন। তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী জনাব সৈয়দ আজিজুল হক সাহেব এই ব্যাপারে কার্যকরী ব্যবস্থাও অবলম্বন করিয়াছিলেন। কিন্তু কি কারণে সে আয়োজন তখন স্থায়ী ও বাস্তবরূপ গ্রহণ করিতে পারে নাই, তাহা আপনারা ভাল করিয়াই জানেন। যাহা হউক আমরা এখন সেই ওয়াদা পালনের সুযোগ পাইয়ছি; এজন্য কোন কৃতিত্বের দাবী আমরা করিতে পারি না-কৃতিত্ব তাঁহাদেরই, যাহাদের বিপুল ত্যাগের বুনিয়াদে জাতীয় গর্বের বস্তু এই বাংলা একাডেমী প্রতিষ্ঠিত হইতেছে।

বাংলা ভাষার ঐতিহ্য

 বাংলা ভাষা সাধারণ মানুষের ভাষা। কোন কোন মহল হইতে বলা হইয়া থাকে যে, সংস্কৃত হইতে বাংলার জন্ম এবং ইহা পৌত্তলিক ভাষা। বলাবাহুল্য, এই কথা মিথ্যা ও অজ্ঞানতাপ্রসূত। ভাষা ও সাহিত্য সম্পর্কে আমার যে সামান্য ধারণা আছে তাহা হইতে আমি বলিতে পারি যে, বাংলা ভাষা ও সাহিত্য কোন বিশেষ ভাষা হইতে উদ্ভুত নয়। পালি, প্রাকৃত, ব্রজভাষা প্রভৃতি হইতে বহু স্তর অতিক্রম করিয়া বহু মিশ্রণের ভিতর দিয়া বাংলার উদ্ভব। এই ভাষা একান্তই এ দেশের ‘প্রাকৃতজন’ তথা সাধারণ মানুষের ভাষা। হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলমান, খৃষ্টান, সকলেই সমবেত প্রচেষ্টা ইহার সমৃদ্ধির মূলে কাজ করিয়াছে। আমার এই মতামত ঐতিহাসিক সত্যকে ভিত্তি করিয়াই গড়িয়া উঠিয়াছে। মধ্য যুগের বাংলার নৃপতি হোসেন শাহ্ বাংলা ভাষার পৃষ্ঠপোষকতা করিয়া ইহার মানোন্নয়নে যে সহায়তা করিয়াছিলেন তাহা বাংলা সাহিত্যে এক সোনালী অধ্যায়। এই আসল বাংলা পদ্য সাহিত্যের এবং পুঁথি সাহিত্যের যে ক্রমবিকাশ শুরু হয়, তাহা দেশের মানুষের হৃদয়ের বস্তু হইয়া উঠে। ইহার সঙ্গে আমাদের দেশের মানুষের নাড়ী ও রক্তের সম্পর্ক আছে। নৃপতি হোসেন শাহের পৃষ্ঠপোষকতার কাল হইতে শুরু করিয়া এই বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে মুসলমানদের যে দান তাহা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে অভূতপূর্বরূপে সমৃদ্ধ করিয়াছে। শঙ্করাচার্য্যের আন্দোলনের পরে যে সমস্ত বৌদ্ধরা পূর্ববঙ্গে আসিয়া আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছিলেন, তাহাদের দানেও এই ভাষা সমৃদ্ধ হইয়াছে। শ্রীচৈতন্যের বৈষ্ণববাদ, আমার মতে, এক বিশেষ শ্রেণীর গরীব সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রসার লাভ করিয়াছে। তাঁহারাও বাহন ছিল এই সাধারণ মানুষের মুখের ভাষা বাংলা ভাষা। বাংলা ভাষা সাহিত্যের খৃষ্টান সমাজেও দান অপরিসীম। উইলিয়াম কেরী, মার্শম্যান, এণ্টনী এবং আরও বহুজনের দানে এই ভাষা আরও গতিশীল এবং সমৃদ্ধ হইয়াছে। প্রথম বাংলা গদ্য-