পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (প্রথম খণ্ড).pdf/৫৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ প্রথম খণ্ড
৩১
শিরোনাম সূত্র তারিখ
“স্বাধীন বাংলা” অবাঙালী ও বৃটিশ কর্তৃক বংগভংগের উদ্যোগের বিরুদ্ধে লেখা সম্পাদকীয় সম্পাদকীয় সাপ্তাহিক ‘মিল্লাত’ ৯ই মে ১৯৪৭

সম্পাদকীয়

স্বাধীন বাংলা

 ৩১ স্বাধীন বাংলা দুইশত বৎসর পরাধীনতার পর বাঙালী জাতি আজ স্বাধীন হইতে চলিয়াছে। আর তের মাসের মধ্যেই বাংলাদেশ স্বাধীন হইবে। বহু ত্যাগ ও সাধনার পর বাঙালীর জীবনে আসিয়াছে এই পরম বাঞ্ছিত শুভক্ষণ।

 কিন্তু কি হতভাগ্য এই বাংলাদেশ-বহু প্রতীক্ষিত এবং দীর্ঘদিনের সাধনালব্ধ এমন একটি শুভক্ষণকে ব্যর্থ করিতে অবাঙালী কায়েমী স্বার্থবাদীদের প্ররোচনায় এই বাংলাদেশেরই একদল স্বার্থান্ধ লোক অতি জঘন্য ষড়যন্ত্রে মাতিয়াছে। বাংলাকে দ্বিখণ্ডিত করিয়া ইহার একটি খণ্ডিত অংশকে কেন্দ্রীয় গভর্ণমেণ্টের তাঁবেদারূপে বাঁধিয়া রাখিতে এই ষড়যন্ত্রকারীর দল তাহাদের সকল শক্তি ও সামর্থ্য নিয়োজিত করিয়াছে।

 সমগ্র ভারতবর্ষকে পরাধীনতার শৃঙ্খলে মজবুত করিয়া বাঁধিতে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদী কেন্দ্রীয় গভর্ণমেণ্ট সৃষ্টি করিয়াছিল। আর, শুধু বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদীই বা বলি কেন? বৃটিশের এদেশে আগমনের পূর্ব ভারতবর্ষ যখনই কোন সাম্রাজ্যবাদীর শাসনাধীনে আসিয়াছে তখনই কেন্দ্রীয় গভর্ণমেণ্টের লৌহ নিগড় ভারতের সকল দেশকে শৃংখলাবদ্ধ করিয়াছে। কিন্তু ভারতের অন্যান্য সকল দেশকে শৃংখলাবদ্ধ করিলেও অতীতে একাধিক সাম্রাজ্যবাদী শত চেষ্টা সত্ত্বেও বাংলাদেশের স্বাধীনতা হরণ করিতে পারে নাই। আর্য্যদের সাম্রাজ্য মিথিলা পর্যন্ত বিস্তার লাভ করিয়াছিল বটে, কিন্তু বাংলাদেশ কখনও আর্য্যদের পদানত হয় নাই। এমন কি অত বড় বড় সব নামকরা সম্রাট মহারাজা অশোক, কনিষ্ক, সমুদ্রগুপ্ত, চন্দ্রগুপ্ত, বিক্রমাদিত্য তাহারাও কেহ বাংলাদেশকে তাহাদের সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করিতে পারেন নাই। গুপ্ত আমল পর্যন্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতার পতাকা কোন বিদেশীর স্পর্শে কলুষিত হয় নই।

 পালবংশ ও সেনবংশের স্বাধীন রাজাদের শাসনাধীন স্বাধীন বাংলা সমগ্র ভারত হইতে বিচ্ছিন্ন থাকিয়া তাহার স্বীয় বৈশিষ্ট্যে রূপায়িত হইয়াছিল। মোহম্মদ বখতিয়ারের বংগ বিজয়ের পূর্ব পর্যন্ত বাঙলার ইতিহাস বলিতে স্বাধীন বাঙলার ইতিহাসই বুঝায়।

 তারপর বিদেশী মুসলমান বাংলাদেশ দখল করিয়া কালক্রমে ইহাকে যখন নিজের দেশ বলিয়া মানিয়া লইল তখন আবার শুরু হইল দিল্লীর কেন্দ্রীয় গভর্ণমেণ্টের বন্ধন হইতে মুক্তির সংগ্রাম। দিল্লীর সুলতান কুতুবুদ্দিনের মৃত্যুর পরই গোড়েশ্বররা দিল্লীর সহিত সকল সম্পর্ক ছিন্ন করিয়া স্বাধীনভাবে বাংলাদেশ শাসন করিতে শুরু করেন। সুলতান আলতামস দিল্লীর সিংহাসনে আরোহণ করার পর ‘বিদ্রোহী’ বাংলাকে পুনরায় শৃংখলিত করিলেন বটে কিন্তু গিয়াসউদ্দীন বলবনের আমলে কেন্দ্রীয় গভর্ণমেণ্টের নিগড় ভাংগিয়া ভুগরল খাঁ আবার বাংলার স্বাধীনতার পতাকা উড়াইয়া দিলেন। এই যে শুরু হইল দিল্লীর কেন্দ্রীয় সরকারের সহিত বাংলাদেশের সংগ্রাম, গোটা পাঠান আমল ও মোগল আমলের শেষ পর্যন্ত এই সংগ্রাম নিরবিচ্ছিন্নভাবে চলিল। ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দীন বারানী বলিয়াছেন, “বাঙলার অধিবাসীদের বিদ্রোহী হওয়ার একটা মজ্জাগত স্পৃহা আছে।” কেন্দ্রীয় গভর্ণমেণ্টের শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হওয়ার এই স্পৃহা বাস্তবিকই বাঙালী চরিত্রের সবচাইতে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। বাংলার স্বাতন্ত্র্য স্বাধীনতা অব্যাহত রাখিতে বাংলাদেশ বরাবর যে লড়াই করিয়াছে সেই লড়াইয়ের ইতিহাসই বাংলার ইতিহাস। দিল্লীর সাম্রাজ্যকে বাংলাদেশ কোনদিনই বরদাস্ত করিতে পারে নাই, আর দিল্লীর