পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (প্রথম খণ্ড).pdf/৫৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ প্রথম খণ্ড
৩২

সম্রাটরাও বাংলার স্বাধীনতাকে কোনদিই সহজ চিত্তে মানিয়া লইতে পারে নাই। তাই কেন্দ্রীয় গভর্ণমেণ্ট ও বাংলার মধ্যে চিরদিন বিরামহীন ও আপোষহীন লড়াই চলিয়াছে। এই লড়াইয়ে কখনও বা পরাজিত হইয়া কেন্দ্রের রাষ্ট্রীয় বন্ধনে বাংলাদেশ বাঁধা পড়িয়াছে আর কখনও বা কেন্দ্রীয় গভর্ণমেণ্টকে পরাজিত করিয়া বাঙলাদেশের স্বাধীন সত্তাকে সমগ্র দুনিয়ার সম্মুখে সে উঁচু করিয়া ধরিয়াছে। দিল্লীশ্বর বারবার পাশবিক শক্তিবলে বাংলার স্বাধীনতা হরণ করিয়াছে বটে, কিন্তু বাংলাদেশ যখনই সময় ও সুযোগ পাইয়াছে তখনই মুহূর্তমাত্র বিলম্ব না করিয়া দিল্লীর রাষ্ট্রীয় বন্ধন ছিঁড়িয়া বাঙলার আজাদীর পতাকা উড়াইয়াছে।

 সমগ্র ভারত হইতে বিচ্ছিন্ন তাহার একক স্বতন্ত্র একটি সত্তা আছে এই অনুভূতি বাংলার সহজাত অনুভূতি। এই অনুভূতির প্রেরণাতেই বাংলাদেশ দুনিয়ার ইতিহাসে এক গৌরবময় ট্র্যাডিশন সৃষ্টি করিয়াছে। ভারতে সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার লোভ তাহার মনে কখনও স্থান পায় নাই। অপরপক্ষে, লড়াইয়ে পরাজিত না করা পর্যন্ত ভারত সাম্রাজ্য পরাধীনতার শৃংখলে তাহাকে কখনও বাঁধিতেও পারে নাই।

 বাঙালী যে সুমহান ট্র্যাডিশনের ধারক ও বাহক সেই ট্র্যাডিশনের প্রেরণাতেই বাংলার স্বতন্ত্র স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠনের বাসনা আজ তাহার মনে জাগিয়াছে। অতীতে পরাধীন বাংলা যখনই লক্ষ্য করিয়াছে, ভারত সরকারের কেন্দ্রীয় গভর্ণমেণ্ট দুর্বল হইয়া পড়িতেছে তখনই সে কেন্দ্রের তাঁবেদারী অস্বীকার করিয়া বাংলার সার্বভৌম স্বাধীনতা ঘোষণা করিয়াছে। আজ ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হইতে চলিয়াছে। তাই ভারত হইতে বৃটিশ সাম্রাজ্যের বিলুপ্তির সংগে সংগে কেন্দ্রীয় গভর্ণমেণ্টের সকল বন্ধন ছিন্ন করিয়া বাংলাদেশ তাহার ট্র্যাডিশনকে সমগ্র জগতের সম্মুখে উঁচু করিয়া তুলিয়া ধরিতে উন্মুখ হইয়া উঠিয়াছে।

 কিন্তু অত্যন্ত লজ্জার কথা, এক শ্রেণীর কায়েমী স্বার্থবাদী দেশদ্রোহীর ভুমিকায় অবতীর্ণ হইয়া বাংলাকে দ্বিখণ্ডিত করিয়া ইহার একটি অংশকে বিদেশীর হাতে তুলিয়া দিতে গভীর ষড়যন্ত্র করিতেছে। অবাঙালীদের প্রতি বিদ্বেষের কথা বাড়ীর পাশে বিহার ও আসামে কংগ্রেস ওজারতীর আমলে প্রবাসী বাঙালীর উপর অত্যাচার ও অবিচারের কথা, অবাঙালী কর্তৃক নিষ্ঠুরভাবে বাংলার ধন-দৌলত শোষণের কথা, নিখিল ভারতীয় কংগ্রেস রাজনীতিতে উপেক্ষিত ও অবহেলিত বাঙালী হিন্দু নেতাদের অপমানের কথা-সব কথাই ষড়যন্ত্রকারীদের জানা আছে; তবু তাহারা বিদেশী ধনিক-বণিকদের প্রেরণায় বাংলাদেশের একটি অংশকে বিদেশীর উপনিবেশে রূপান্তরিত করিতে উন্মত্ত হইয়া উঠিয়াছে। বাঙালী হইয়াও যাহারা বাংলা দ্বিখণ্ডিত করার পক্ষে ও বাংলার স্বাধীনতার বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলিয়াছে তাহাদিগকে একটি প্রশ্ন করিতে চাই। বাঙালীর রক্ত শোষণ করিয়া যাহারা বিত্ত সঞ্চয় করিয়াছে তাহারা আজ অকস্মাৎ এমন পরোপকারী হইয়া উঠিল কেন? বংগভংগ আন্দোলনকে সাফল্যমণ্ডিত করিতে তাহারা দুই হাতে পানির মত অর্থ ব্যয় করিতেছে কেন? এই কেনার কি কোন জওয়াব নাই? জওয়াব আছে। আর সেই জওয়াবের ভিতরেই বংগভংগ আন্দোলনের সকল গূঢ় রহস্য নিহিত।

 ভারতের অন্যান্য প্রদেশের প্রবাসী বাঙালীদের উপর যে নির্যাতন চলিতেছে সেই নির্যাতনের বিরুদ্ধে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত প্রবাসী বংগীয় সাহিত্য সম্মেলনে যে সব তীব্র মন্তব্য ও প্রস্তাবাদি পাশ করা হইয়াছে তাহা সবারই জানা আছে। কিন্তু সবকিছু জানিয়া-শুনিয়াও বাংলার ট্র্যাডিশনকে পদদলিত করিয়া অখণ্ড ভারতের তাঁবেদারূপে বাংলার একটি অংশকে বাঁধিয়া রাখার জন্য গুটিকয়েক কায়েমী স্বার্থবাদী বাঙালী আজ ক্ষেপিয়া উঠিয়াছে। ইহাদের এই ক্ষেপামীর ফলে বাঙালীর জীবনে যে কি ভয়াবহ অভিশাপ দেখা দিতে পারে, সে সম্পর্কে আমরা বারান্তরে আলোচনা করিব।