পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (প্রথম খণ্ড).pdf/৬২০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ প্রথম খণ্ড
৫৯৫

দেশের সকল শ্রেনীর জনসাধারণের মধ্যে বিদ্যমান। কিন্তু মাত্র ৯টি বংসর না যেতেই আজ মুসলিম লীগ জনসাধারণের মন থেকে ধুয়ে মুছে গেল। এত বড় একটা রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের এরূপ অবস্থা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। বিগত সাধারণ নির্বাচনে মুসলিম লীগের যে হার হয়েছে সে রূপ হার পৃথিবীর কোন দেশে কোন কালে কোন ক্ষমতাসীন দলের হয়নি।

 কেন এমন হলো? কেন মুসলিম লীগের এমন শোচনীয় মৃত্যু হলো? আওয়ামী লীগ কর্তৃক কেন্দ্রে ও প্রদেশে আংশিক ক্ষমতা অধিকারের পর বৈজ্ঞানিক মন নিয়ে এ প্রশ্নের সম্মুখীন হওয়া প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। মনে রাখতে হবে যে, অতন্দ্র দুষ্টি এবং সর্বদা তীক্ষ প্রহরাধীন না রাখলে ক্ষমতা রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের মৃত্যু যত শিগগির ডেকে আনে তত শিগগির আর কিছুতে আনে না। বিরোধী দল হিসাবে দু'একটা ভুল করলে সর্বসাধারণ অনেক সময় ক্ষমা করে থাকে, কিন্তু ক্ষমতাসীন দল হিসাবে ভূল করলে সে ভূলের ক্ষমা নেই।

 মুসলিম লীগ কি কি ভুল করেছিল তার একটি হিসাব নিলেই আমাদের পক্ষে সাবধান হওয়া সহজ হবে। বলে নিম্নে আমার জ্ঞান বুদ্ধিমত মুসলিম লীগের ভূলগুলি একে একে বলছিঃ

 প্রথমঃ ক্ষমতা তাদের মাথা গুলিয়ে দিয়েছিল। তার প্রমাণ পূর্ব পাকিস্তানের সাড়ে চার কোটি লোকের মতামত না নিয়ে মুসলিম লীগ করাচীতে রাজধানী নিয়ে গেল, উর্দু রাষ্ট্রভাষা হবে বলে ঘোষণা করল এবং সর্বোপরি পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থ ও চাকরি বণ্টনে বৈষম্যমূলক নীতি অনুসরণ করে চললো।

 দ্বিতীয়তঃ তারা ব্যক্তিগত বা দলগত স্বার্থ রক্ষার জন্য রাজনীতিতে ধর্মকে টেনে আনলেন। নিছক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে যার জন্ম সেই মুসলিম লীগের দোষত্রুটির ন্যায্য সমালোচনাকে তারা ইসলাম বিরোধিতা, রাষ্ট্রদ্রোহিতা প্রভৃতি আখ্যায় আখ্যায়িত করে জনমনে একটা ত্রাসের সঞ্চার করার প্রচেষ্টায় মত্ত হলো।

 তৃতীয়তঃ মুসলিম লীগ নেতাদের অধিকাংশের ব্যক্তিগত জীবনে ইসলামের অনুশাসন রক্ষিত হওয়ার নামমাত্র চিহ্ন পরিলক্ষিত না হলেও তারা রাজনৈতিক সভাসমিতিকে প্রধানতঃ ধর্মমূলক ওয়াজ-নসিহতের জলসায় পরিণত করলেন।

 চতুর্থতঃ মুসলমানের আল্লাহ এক, ধর্ম এক, রসূল এবং এবং কেতার এক-এই যুক্তিতে রাজনৈতিক দলও হবে এক বলে প্রচার চালালেন তারা। একই যুক্তিতে তারা বলে যেতে লাগলেন বিরোধী দল মাত্রই রাষ্ট্রদ্রোহী।

 পঞ্চমতঃ মুসলিম লীগের কর্ণধারগণ পাকিস্তানকে তাদের ব্যক্তিগত জমিদারী মনে করে নিজেদের ব্যাংক ব্যালেন্স এবং সম্পত্তি ইত্যাদির জন্য রাষ্ট্রের ধন ও সম্পদ নির্লজ্জ লুণ্ঠনে মত্ত হলেন। লীগের উপরের স্তরের লোকগণ চরম দুর্নীতি, চোরাকারবারি এবং স্বজনপ্রীতিতে গা ভাসিয়ে দিলেন, এ অবস্থা যখন সরকারী কর্মচারীগণের কাছে ধরা পড়লো তখন তাদেরও অনেকে পাকিস্তান লুণ্ঠনের কার্যে অবতীর্ণ হলেন (গোলাম মুহম্মদের জামাতা হোসেন মালিক ফ্রান্স থেকে ওয়াগন কেনার নামে কেন্দ্রীয় সরকারের ৪৬লাখ টাকা ৭/৮ বৎসর ধরে ব্যাক্তিগত অহবিলভুক্ত করে রেখেছেন)। পাকিস্তান হবার পর মুসলিম লীগের নেতা, উপনেতা ও সরকারী কর্মচারীদের অনেকেই আংগুল ফুলে কলাগাছ হয়েছেন। তাদের সম্পত্তি কিভাবে অর্জিত হলো যদি তার তদন্ত কোন দিন হয় তবে পাকিস্তান লুণ্ঠনের যে চিত্র জনসম্মুখে প্রকাশিত হয়ে পড়বে, তা অতীতের সমস্ত রাজনৈতিক অসততা, দুর্নীতি, ফেরেববাজি ও চুরিচামারিকে হার মানাবে।

 ষষ্ঠতঃ পাকিস্তানের মালিক হওয়ামাত্র মুসলিম লীগ নেতাগণ নিজেদের ক্ষমতা ও যোগ্যতার সীমারেখা ভূলে গেলেন। একথা অস্বীকার করা চলে না যে, পাক-ভারত উপমহাদেশে থেকে ক্ষমতাচ্যুত হবার পর মুসলমানদের সমাজ জীবন গোমরাহী ও মূর্থতায় নিমজ্জিত হয়। সেই গোমরাহী ও মূর্থতা থেকে জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তারা