পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (প্রথম খণ্ড).pdf/৬২১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ প্রথম খণ্ড
৫৯৬

প্রচেষ্টা করতে থাকে মাত্র বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশক থেকে। ভারতীয় মুসলমানদের সমাজ জীবনে মধ্যবিত্ত শ্রেণী গড়ে উঠতে থাকে মাত্র বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশক থেকে। সে গড়া আজও শেষ হয়নি। পূর্ব পাকিস্তানে যদিও তা আজ অনেকটা সুদৃঢ়; কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানে তা আজও গড়েনি। মুসলিম লীগ নেতাগণ এই ঐতিহাসিক সত্য ভুলে গেলেন, তারা নিজেদের মনে করতে লাগলেন পরম ও চরম বিজ্ঞতার অধিকারী ও নির্ভুল। ফলে মূর্খতার সংগে অহমিকা বা ইংরেজীতে যাকে বলে এরোগেল, তার মিশ্রণ হলো। মূর্থ নিজের মূর্থতা স্বীকার করে কার্যে অবতীর্ণ হলে এবং অপরের গঠনমূলক উপদেশাদি গ্রহণে রাজী হলে তা তেমন দৃষ্টিকটু হয় না। কিন্তু মূর্খতা ও আত্মম্ভরিতার মিশ্রণ একেবারেই অসহ্য।

 সপ্তমঃ মুসলিম লীগ অর্থনৈতিক রাজনীতি সংগে মিশিয়ে ফেললেন। রাজনীতিতে অনেক সময় জনগণের ভাবালুতা কাজে লাগাতে হয়। কিন্তু অর্থনীতি বর্তমানে জগতে বিজ্ঞানের একটি শাখা। সুতরাং ভাবালুতাভিত্তিক অর্থনীতি আধুনিক জগতে একেবারেই অচল। বাণিজ্যের মূল কথাই হলো লাভ-লোকসান। চরম শত্রর সংগেও লাভ হলে ব্যবসা করতে হয়। কিন্তু লীগ কর্ণধাররা বাণিজ্যের মূলনীতি বিস্মৃত হয়ে ভারতের সংগে কায়কারবার প্রায় বন্ধ করে দিলেন। স্বাধীনতার পর ভারত পাকিস্তান থেকে ৪০ লাভ বেল পাট ও ১৫ লাখ বেল তুলা কিনত, কিন্তু আজ কেনে মাত্র দশ লাখ বেল পাট। ভারত পাট উৎপাদন বৃদ্ধি করল, আমরা অবলম্বন করলাম “পাট উৎপাদন কমাও নীতি”। মুসলিম লীগ সরকার চীন, রাশিয়া প্রভৃতি দেশের সংগে বাণিজ্যিক সম্পর্কে স্থাপনে বহুকাল ইতস্ততঃ করেছে। এখানেই শেষ নয়, দুনিয়ার সব দেশ যখন মুদ্রার মূল্যমান কমিয়ে দেয় তখন এই একাউণ্টেট অর্থনীতি বিশারদরা পাকিস্তানী মুদ্রার মূল্যমান পূর্ব হারেই রেখে দেন, কিন্তু এর থেকে যে লাভ হলো তার এতটুকুও দেশের জনসাধারণকে পাইয়ে দেবার কোন ব্যবস্থা করলেন না। এরা দেশের দুই অংশের মধ্যে স্বর্ণের দু'রকম মূল্য নির্ধারণ করে কার্যত পাকিস্তানের দুই অংশের অর্থনীতি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র স্বীকার করেও, নিজেদের স্বার্থোদ্ধার ও পূর্ব পাকিস্তানকে লণ্ঠনের জন্যে উভয় পাকিস্তানকে এক অর্থনীতির জোয়ালে আবদ্ধ করে লাঙ্গল ধরলেন। এই অশ্রুতপূর্ব মূর্খতার ফলে আজ পাকিস্তানী অর্থনীতি বিপর্যস্ত জনসাধারণ আজ অবর্ণনীয় দুঃখ-দুর্দশার সম্মুখীন, পূর্ব পাকিস্তান আজ ভিখারীর দেশে পরিণত: অপর যে-কোন সভ্য দেশে রাষ্ট্র পরিচালকগণের মধ্যে মূর্খতা ও আত্মম্ভরিতার এরূপ সমাবেশ হলে দেশের লোকের বিচারে তাদের গুরুতর শাস্তি হতো।

 অষ্টমতঃ ইংরেজ আমলে মাথাভারি শাসন ব্যবস্থা পরিবর্তন করা দূরের কথা, মুসলীম লীগ তাকে পূর্বাপেক্ষাও মাথাভারি করতে প্রস্তুত হলেন। যে দেশের মাথাপিছু বার্ষিক আয় এখন পর্যন্ত সম্ভবতঃ একশত টাকার উর্ধ্বে নয়, সেই দেশে বার্ষিক দু'তিন লাখ টাকা পর্যন্ত আয়ের পদ রাখার নজীর বর্তমান দুনিয়ায় নেই। গ্রেট বৃটেনের মত উন্নত দেশের প্রধানমন্ত্রীর বেতনের চাইতে বেশী এদেশের অনেকের মাসিক বেতন। পাকিস্তানের মত দরিদ্র দেশের বৈদেশিক দূতাবাস, ট্রেড কমিশন, ডেলিগেশন প্রভৃতির সংখ্যা কানাডা ও বৃটেনের মত উন্নত রাষ্ট্রের চাইতেও সম্ভবতঃ অনেক বেশী, অথচ অতি সহজেই একটি বৈদেশিক দূতাবাস থেকে অনেক ক্ষেত্রে একাধিক দেশে কাজ করতে পারে।

 মোট কথা, মুসলিম লীগ মুখে ধর্মের জিগির এবং কার্যত দেশের জনসাধারণকে ইংরেজ আমল অপেক্ষাও দারিদ্র নিমজ্জিত করে দেশকে ভিক্ষুকের দেশে পরিণত করার যে অদম্য উৎসাহ ও প্রচেষ্টায় মত্ত হলো, তার নজীর কোন ইতিহাসে নেই। তাদের এই প্রচেষ্টার ফলে দেশ আজ দৈনন্দিন খরচের জন্য পরমুখাপেক্ষী। বিদেশের অর্থ সাহায্য ছাড়া আজ পাকিস্তান অচল। এজন্য রাজনৈতিক স্বাধীনতা পর্যন্ত বিসর্জন দেওয়ার মত অবস্থায় গিয়ে পৌঁছেছে দেশ।

 বিরোধী দলের অস্তিত্ব রাষ্ট্রের জন্যে সরকারী দলের মতই সমান প্রয়োজন বলে মনে করতে হবে। বিরোধী দলের ‘শির কুচল’ দেওয়ার কল্পনা পরিত্যাগ করতে হবে। বিরোধী দলের কারও দেশপ্রেমে সন্দেহ প্রকাশ করার