পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (প্রথম খণ্ড).pdf/৬২২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ প্রথম খণ্ড
৫৯৭

নীতি বর্জন করতে হবে। মোট কথা, পূর্ণ পালামেণ্টারী শাসন এবং সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা হবে আমাদের লক্ষ্যস্থল।

 ইতিহাস সাক্ষী, কোন দেশের জনসাধারণ কোন কালেই ভুল করেনি। যারা বলেন যে, নিরক্ষরতা বা অজ্ঞতার জন্য জনসাধারণ ভুল করতে পারে, সুতরাং জনসাধারণের উপর পূর্ণ আস্থা রাখা যায় না, তাদের সংগে জনসাধারণের কোন পরিচয় কোন পরিচয় নেই। সমবেতভাবে জনসাধারণ যদি ভুলই করত, তবে তারা পাকিস্তান আনতে পারত না। পূর্ব বাংলার বিগত সাধারন নির্বাচনে জনতা যে অপূর্ব রাজনৈতিক প্রজ্ঞার প্রমাণ দিয়েছে, তার তুলনা নেই।

 এখন পর্যন্ত আমাদের অনেক কাজ বাকী। একুশ দফা ওয়াদার মূল দফা এবং আওয়ামী লীগ ম্যানিফেষ্টোরও প্রধান কথা হল পররাষ্ট্র, মুদ্রা এবং দেশরক্ষা বিভাগ ছাড়া আর সকল বিভাগের ভার প্রদেশকে দিতে হবে। কারণ যতদিন না পূর্ব পাকিস্তান তার অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করার পূর্ণ ক্ষমতা পাচ্ছে, যতদিন না শিল্প ও বাণিজ্য, রেলওয়ে, পোষ্ট অফিস প্রভৃতি বিভাগগুলির পূর্ণ কর্তৃত্ব স্থানীয় সরকারের হাতে আসছে, যতদিন না পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানকে অর্থনৈতিক বিচারে দুটি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ইউনিট বলে স্বীকার করা হচ্ছেততদিন পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানের সর্বাঙ্গীণ মঙ্গল সম্ভব নয়।

 বিনা খেসারতে জমিদারী উচ্ছেদ আর একটি ওয়াদা। সমস্ত মধ্যস্বত্বভোগীদের খেসারত দিতে হলে পূর্ব পাকিস্তানকে অন্ততঃ ৬০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ স্বরূপই দিতে হবে, টাকা দেওয়ার মতো ক্ষমতা পূর্ব পাকিস্তান সরকারের নেই। যে টাকা জমিদার-তালুকদারকে ক্ষতিপূরণ স্বরূপ দেওয়ার ব্যবস্থা বর্তমান আইনে আছে, সে টাকা দ্বারা এদেশে বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে কর্মক্ষম জমিদার-তালুকদারদের যোগ্যতামত নিয়োগ করা যেতে পারে। সংগত মনে হলে ঐ সকল শিল্পের কিছু শেয়ারও তাদের দেয়া যেতে পারে।

 শিক্ষা-পূর্ব পাকিস্তানে ১৬% মাত্র অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন। প্রাথমিক শিক্ষাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক করার ওয়াদার আমরা আবদ্ধ। ১৯৪৮ সালে পূর্ব পাকিস্তানের ম্যাট্রিক পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল প্রায় ৬০ হাজার এখন ৩০-৩৫ হাজার; হাইস্কুল ও হাই-মাদ্রাসা মিলে ছিল প্রায় ২ হাজার, এখন কাগজেপত্রেই মাত্র ১৪ শত। মধ্যে ইংরেজী ও জুনিয়র মাদ্রাসার সংখ্যা ছিল প্রায় ২,৫০০ এখন নেই বললেই চলে। শিক্ষকের সমস্যা আরো গুরুতর- প্রাথমিক শিক্ষকের বেতন সরকারী ৪র্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের চেয়েও কম।

 সামরিক বিভাগ কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রাধীন থাকবে আমরা বলেছি: কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, সামরিক বিভাগের নিয়োগ থেকে পূর্ব পাকিস্তানী যুবকরা চিরকালের জন্য বঞ্চিত থাকবে। সামরিক বিভাগের ২ লক্ষ কর্মচারীর মধ্যে ৫% জনও পূর্ব পাকিস্তানী নয়। পাকিস্তান সরকার দেশরক্ষা খাতে বৎসরে রাজস্ব খাত থেকেই প্রায় সত্তর কোটি টাকা ব্যয় করেন, এছাড়া বৈদেশিক সাহায্য তো আছেই। এই টাকার পনেরো আনাই ব্যয় হয় পশ্চিম পাকিস্তানে। অথচ দেশ রক্ষার অধিকার সকলের সমান। জাপান ও চীনাদের মত খর্বকায় ব্যক্তিরা যুদ্ধের উপযোগী হতে পারলে পূর্ব পাকিস্তানী যুবকরা সামরিক বিভাগের জন্য উপযোগী কেন হবে না তা বুঝে ওঠা কঠিন। আমরা সংখ্যাসাম্য মেনে নিয়েছি দেশের সকল ব্যাপারে সংখ্যাসাম্য ভোগ করব বলে- কেন্দ্রীয় সরকারের মোট খরচের শতকরা পঁচাত্তর ভাগ থেকে বঞ্চিত হবার জন্যে নয়।


 পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি বর্গমাইলে প্রায় নয়শত লোক বাস করে; পক্ষান্তরে পশ্চিম পাকিস্তানে এই সংখ্যা এক শতেরও কম। কাজেই পূর্ব পাকিস্তানে শত ইচ্ছা করলেও কৃষির খুব উন্নতি করা সম্ভব নয়। সুতরাং বিজ্ঞানসম্মত ব্যবস্থা হল পশ্চিম পাকিস্তানে যান্ত্রিক কৃষি ব্যবস্থার প্রবর্তন এবং পূর্ব পাকিস্তানকে ব্যাপকভাবে শিম্পায়িত করা। কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ব পাকিস্তানকে শিম্পায়িত করার কার্যে এ পর্যন্ত চরম অবহেলা প্রদর্শন করে আসছেন। পশ্চিম পাকিস্তানে তারা সমস্ত ভারী শিল্প কেন্দ্রীভূত করেছেন।