পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (প্রথম খণ্ড).pdf/৬৭০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ প্রথম খণ্ড
৬৪৫
শিরোনাম সূত্র তারিখ
রাষ্ট্রভাষা বাংলার সপক্ষে একটি নিবন্ধ ‘ইত্তেহাদ’ ২০ জুলাই, ১৯৪৭

রাষ্ট্রভাষা বিষয়ক প্রস্তাব
  মাহবুব জামাল জাহেলী

 পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কি হইবে, ইহা লইয়া প্রচুর আলোচনা চলিতেছে। এই সমস্যাকে কেন্দ্র করিয়া যে সকল বিভিন্নমুখী চিমত্মধারার প্রকাশ হইতেছে, তাহা মুসলিম বাংলার জনগণের প্রাণ প্রাচুর্য্যেরই পরিচয় বহন করে। আলোচনার আলোকেই প্রকৃত পথের সন্ধান পাওয়া যায়, সুতরাং এই তর্ক-বিতর্কে আশংকিত হইবার কোন কারণ নাই।

 প্রধানতঃ বাংলা ও উর্দুকে লইয়াই এখন বিতর্কের উদ্ভব হইয়াছে। এবং প্রকৃতপক্ষে অন্য কোন ভাষা পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা রূপে গণ্য হইতে পারে না। প্রত্যেক ভাষার সমর্থনেই অনেকে অনেকে জোরালো যুক্তি-তর্ক উপস্থাপিত করিয়াছেন। এবং এই প্রসংগে যে বিতর্কের সৃষ্টি করা হইয়াছে তাহাকে উচ্ছাসও প্রচুর পরিমাণে আছে। কিন্তু প্রশ্নটি আদৌ উচ্ছাস-সাপেক্ষে নহে। সম্পূর্ণ নিরপেক্ষভাবে প্রত্যেকটি ভাষার দাবী বিচার করিতে হইবে। এ জন্যই প্রথমেই রাষ্ট্রীয় ভাষার উপযোগী গুণাবলীর নির্ণয় প্রয়োজন। নিমণলিখিত বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত একটি ভাষা রাষ্ট্রীয় ভাষার আসন পাইবার উপযুক্ত বলিয়া মনে করা যইতে পারেঃ

(১)ভাষাভাষীর সংখ্যা মুষ্টিমেয় হইলে চলিবে না।

(২)দুই ভাষাভাষীর রাজনৈতিক প্রতিপত্তি পাকিস্তানের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বিশেষ ক্ষমতা সম্পন্ন হইবে।

(৩)এই ভাষার মাধ্যমে ইসলামের ভাবধারাকে ভাষাভাষীর মধ্যে পরিসস্ফুট করিয়া তুলিতে হইবে।

(৪)এই ভাষার ব্যাকরণ, বর্ণমালা ও লিপি জটিলতা বর্জিত হইবে।

 পাকিস্তানের জনসংখ্যায় প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ লোক বাংলা ভাষায় কথাবার্তা বলিয়া থাকে, সুতরাং উপরোক্ত আদর্শে বাংলার দাবীই অগ্রগণ্য। গনতান্ত্রিক যুগে যদি গণভোট এই ভাষা সমস্যার সমাধানের প্রস্তাব উঠিত, তবে নিঃসন্দেহে বাংলা ভাষায় হইত সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। কিন্তু এই প্রস্তাবে পশ্চিম পাকিস্তানের উপর অবিচার করা হয়। রাষ্ট্রের একটি বিশিষ্ট অংশের সুবিধার্থে অন্য অংশে অসুবিধা সৃষ্টি করা কোন রাষ্ট্রেরই কাম্য নহে এবং হওয়া উচিত নহে। প্রাদেশিক প্রভৃতির রাষ্ট্রভাষারূপে পরিগনিত হইবার দাবিকে নিতান্তই জিদ বলিলেও অত্যুক্তি হইবে না। এবং উর্দু ভাষা-ভাষীর সংখ্যাও বাংলার তুলনায় নিতান্তই স্বল্প। ইহা ব্যতিত উর্দু ভাষা বাংলার অধিকাংশ জনগণের নিকটই যে কোন বিদেশী ভাষার ন্যয়ই দুর্বোধ্য ঠেকিতে বাধ্য। সুতরাং এইদিক হইতে বিচার করিলে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দু হইবার কোন দাবিই যুক্তিযুক্ত হয় না। রাজনীতি ক্ষেত্রে বাংলা ভাষাভাষীর প্রতিপত্তি প্রচীনকাল হইতেই প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছে। এই সবজন-বিদিত প্রতিপত্তি দর্শনেই মহামতি গোখলে বলিয়াছিলেনঃ What Bengal things today, India things tomorrow.

 হৃত-গৌরব ফিরিয়া পাইবার জন্য বাংলার মুসলমান চঞ্চল হইয়া উঠিয়াছে। ইহার প্রস্তুত প্রমান পাওয়া যাইতেছে। এইদিক হইতে বিচার করিলে কিছুকাল পূর্বে উর্দু ভাষার কোস দাবীই থাটিতে না। কিন্তু বাঙালী মুসলমানদের অবস্থা-বিপর্যয়ের সুযোগ গ্রহণ করিয়া ঐ ভাষাভাষীরা তাহাদের দাবীকে শক্ত করিয়া তুলিতেছে। কিন্তু নিরপেক্ষভাবে এই পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করিলে ইংরেজী ভাষার দাবী অবশ্যই অগ্রগন্য, কারণ এতদিন রাজনীতি ক্ষেত্রে ইংরেজীৱই প্রাধান্য ছিল। তবে বৈদেশিক কোন ভাষাই পাকিস্তানের কোনও রাষ্ট্রেরই রাষ্ট্রীয় ভাষা হইতে পারে না-এই জন্য ইংরাজীর দাবী মানিয়া লওয়া যায় না। সুতরাং উর্দু এবং বাংলার দাবীই মাত্র এখন আমাদের বিচার্য। কিন্তু উর্দুও যে প্রকৃতপক্ষে এই দেশীয় ভাষা এই কথাও বলা চলেনা। উর্দু হইল তুর্কী শব্দমানে ‘শিবির’। সৈন্যদের মধ্যে আলাপ-আলোচনার সুবিধার্থে সম্রাট আকবর এই ভাষার উদ্ভাবন করেনশিবিরজাত বলিয়াই এই ভাষার এই নাম। সুতরাং দেখা যাইতেছে, উর্দু ভাষা প্রকৃতপক্ষে দেশের ভাষা নয়।