পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (প্রথম খণ্ড).pdf/৬৭২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ প্রথম খণ্ড
৬৪৭

এবং পররাষ্ট্র বিভাগের উপর যদি কেন্দ্রের কর্তৃত্ব থাকে, তবে অসুবিধা বিশেষ কিছু হইবে না। কেন্দ্রের সহিত দোভাষী অনবাদকের সাহায়্যে কাজ অনায়াসেই সমাধা করা যায়। বর্তমানে প্রাদেশিক সরকারের অনুবাদ বিভাগের মত একটি বিভাগ খুলিলেই সব গোলমাল চকিয়া যাইবে এবয় অন্যান্য প্রদেশের সহিতও এই উপায়েই যোগসূত্র অক্ষুন্ন রাখা যাইবে। শুধু যে বায়লা দেশের জন্যই কেন্দ্রীয় অফিসে অনুবাদকের দফতর খলিতে হইবে, এমন নয়। কেন্দ্রের রাষ্ট্রভাষা যে উন্নত উর্দু কিংবা বাংলা হইবে একথা অবধারিত। সুতরাং বিদেশী রাষ্ট্রের সহিত যে সংবাদ আদান-প্রদান করিতে হইবে, তাহার জন্যও অনুরূপ দফতরের প্রয়োজন হইবে। এবং হিন্দুস্তান রাষ্ট্রের মধেও অনুরূপ ব্যবস্থা করিতে হইবে কারণ হিন্দুস্তানের রাষ্ট্রভাষা হইবে হিন্দি বা হিন্দুস্তানী।

আপাতঃদৃষ্টিতে আরও একটি বিষয়েও আমাদের অসুবিধা হইবে বলিয়া মনে হয়। সেটি হইল সৈন্য বিভাগে ভাবের আদা-প্রদান। পূর্ব পাকিস্তানের সেবাহিনী ও পশ্চিম পাকিস্তানের সেনাবাহিনীরা স্ব স্ব প্রদেশের স্বীয় প্রাদেশিক রাষ্ট্রভাষায়ই কথাবার্তা বলিতে পারিবে। কিন্তু যখন এই দুই প্রদেশের সেনাবাহিনী প্রয়োজনানুসারে একত্রিত হইবে, তখনই অসুবিধা হইবে বেশী। পারস্পারিকভাবে আদান-প্রদান ছাড়াও আদেশ ওয়া (কমাণ্ড) লইয়াও অসুবিধা ভোগ করিতে হইবে মনে হয়। কারণ, বর্তমানে বিভিন্ন দেশীয় সেনানী লইয়া সেনাবাহিনী গঠিত হইলেও আদেশকার্য চালানো হয় ইংরাজীতে। কিন্তু তখন ইংরাজী বর্জন করা হইবে। এই সমস্যা গরম্নতর হইলেও অতি সহজেই ইহার সমাধান করা যায়। যদি আমরা আদেশবিধিগুলির (Commandments) আরবী ভাষা প্রচলন করি, তবেই অসুবিধার নিরসন হয়। আরবীতে আদেশ দিলে উহা ইংরাজী হইতেও শক্তিশালী হইবে। কারণ আরবী ভাষায় যে ঝংকার, যে দ্যোতনা আছে, সে দ্যোতনা ও ঝংকার ইংরাজী ভাষার নাই। দুই রাষ্ট্রের অবািসীগণ পরস্পরের সহযোগিতা করিলেই এই সমস্যা এবং অনুরূপ সকল মসস্যারই সমাধান সহজসাধ্য হইয়া যাইবে। নিজস্ব জিদ বজায়া রাখিবার জন্য গোঁড়ামীর আশ্রয় গ্রহণ করা কাপুরুষোচিত ব্যবহার বলিয়াই অবিহিত হইবে। পরস্পরের প্রতি সৌহার্দ্য না থাকিলে কোন রাষ্ট্রেরই উন্নতি বিদান সম্ভবপর হইবে না, একথা সুনিশ্চিত।

প্রথম প্রথম অসুবিধা হইবেই, কিন্তু ধীরে ধীরে যখন জনসাধারণ এবং কর্মীগণ নুতন পরিবেশের সহিত নিজকে খাপ খাওয়াইয়া লইতে পারিবেন, তখন কোন অসুবিধাই ভোগ করিতে হইবে না।

পশ্চিম বংগের হিন্দুগণ পূর্ব বংগ হইতে দ্বিধা-বিভক্ত হইয়া গিয়া যেমন স্বয় সত্তা বিসর্জন দিল, পূর্ব বংপের মুসলমানগণও অনুরূপ অবস্থার সম্মুখীন হইবে, যদি উর্দুকেই সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করা হয়। হিন্দুস্তানের রাষ্ট্রভাষা যে হিন্দুস্তানী হইবে, ইহা নিশ্চিত এবং তাহা হইলে বাংলা সাহিত্যে পশ্চিমবংগের যা দান তাহাও নিঃশেষে লোপ পাইবে। তাহাদের সংস্কৃতি, তাহাদের আভিজাত্য সকলই খর্ব হইয়া যাইবে। পূর্ব পাকিস্তানেরও অবস্থা ইহাই হইবে, যদি রাষ্ট্রভাষা বাংলা না হয়। আমার দৃঢ়বিশ্বাস, বাংলার মুসলমানগণ কখনই ইহা ঘটিতে দিবে না...।

উর্দুও আমরা শিখিব আমাদের পশ্চিম পাকিস্তানের ভাইদের শিক্ষা-সংস্কৃতি জানিতে হইবে বলিয়া। কিন্তু তাহাদিগকেও বাংলা শিক্ষা করিতে হইবে, নতুবা তাঁহারা এক দেশদর্শিতার পরিচয় প্রদান করিবেন।


* পাকিস্তান প্রতিষ্ঠান বেশ কিছুকাল আগে থেকে রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে আলোচনা চলছিল। এই প্রবন্ধটি বাংলায় সপক্ষে একটি প্রস্তাব। প্রবন্ধটি কলকতা হতে প্রকাশিত ‘ইত্তেহাদ' পত্রিকায় ২০শে জুলাই, ১৯৪৭ সালে প্রকাশিত হয়।