পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (প্রথম খণ্ড).pdf/৭৭৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ প্রথম খন্ড
৭৪৯

 ইহা সত্য যে, সাম্প্রদায়িকততা পাকিস্থানের গণজীবনে একটি সমস্যা হইয়াই রহিয়াছে। উহার অবসানের সর্বরকমের আয়োজন করিতে হইবে। কিন্তু পৃথক নির্বাচন দ্বারা এই সমস্যাকে কিছুতেই দূর করা সম্ভব নহে। উহা দ্বারা এই সাম্প্রদয়িকতাকে উস্কানিই দেওয়া হইবে। সাম্প্রদায়িকতার বিষ বপনে অতী উৎসাহী প্রচারকের এই পৃথক নির্বাচনের অভিযানে যাঁহাদিগকে বিভ্রান্তির ফাঁদে ফেলিতে সক্ষম হইয়াছেন, তাঁহাদের এই অসীম সর্বনাশা পরিণতি সম্বন্ধে ভাবিয়া উহার অবসান করা যায় না। রাষ্ট্র ব্যবস্থার প্রতিক্ষেত্রে কি সামাজিক, কি অর্থনৈতিক, কি রাজনৈতিক, সকল সম্প্রদায়ের সকল সম্প্রদায়ের সকল ধর্মের সকলের অবাধ অধিকার এই মহান প্রীতির দ্বার উন্মুক্ত করিতে পারে।

 পৃথকভাবে নির্বাচিত হওয়ার পরে পরিষদের সদস্যরা যে কোন আইন পাশ করাইতে যুক্তভাবেই ভোট দিতে পারেন। অন্যদিকে সুপারীর ট্যাক্য হ্রাস, পাটের মূল্য বৃদ্ধি, রেশন ব্যবস্থা, খাজনা হ্রাস, সার্টিফিকেট প্রথা বাতিল প্রভৃতি জনহিতকর আইনগুলি গৃহীত হইলে কেবলমাত্র একটি সম্প্রদায়েরই উপকার হয় না, প্রত্যেকটি পাকিস্তানী উহার দ্বারা উপকৃত হয়। ধর্ম ও সম্প্রদায় নির্বিশেষে কোন সদস্যই যে কোন আইনের স্বপক্ষে অথবা বিপক্ষে ইচ্ছামত নিজ ভোট দিতে পারেন। ধর্মীয় কূটতর্কের মীমাংসার জন্য রক্ষাকবচ নামে পৃথক নির্বাচনের জন্য ব্যবস্থা নাই, অথবা মন্ত্রী হওয়ার বেলায় এই সংখ্যালঘু সদস্যদের ভোটকে বর্জন করা হয় না। অথচ জনগণ সম্মিলিত ও যুক্তভাবে ভোট দিয়া নিজেদের সমস্যা সমাধানের জন্য প্রতিনিধি নির্বাচিত করিতে পারিবেন না, এই যুক্তি সম্পূর্ণ অচল।

 পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা পরিচালনার জন্য গুলি যন্ত্র রহিয়াছে তাহার কোথাও পৃথক নির্বাচন নাই। ইউনিয়ন বোর্ড, লোকাল বোর্ড: জিলা বোর্ড, মিউনিসিপ্যকালিটি: পার্লামেণ্ট প্রভৃতিতে যুক্ত নির্বাচন চালু রহিয়াছে। নেজামে ইসলামের সভাপতি ও পৃথক নির্বচনের অন্যতম নেতা মাওলানা আতাহার আলী এই যুক্ত নির্বাচনেই জাতীয় পষিদের সদস্য নির্বাচিত হইয়াছেন। মিঃ গিবনের সভাপতিত্বে তাহারা ইসলামী শাসনতন্ত্র পাশ করাইয়াছেন। হিন্দু মুসলমান সকল সদস্যের ভোটে জনাব ইস্কান্দার মীর্জা “সদরে রিয়াসত” প্রেসিডেনট নির্বাচিত হইয়াছেন বর্তমান পূর্ব পাকিস্তান মন্ত্রীসভায় যেখানে নেজামে ইসলামের জনাব আশরাফউদ্দীন চৌধুরী মন্ত্রী চিলেন, সেইখানে তিনজন হিন্দু মন্ত্রী মন্ত্রীদের সমান অধিকার লইয়া বিরাজ করিয়াছেন। মন্ত্রীসভার সিদ্ধান্তে এই হিন্দু মন্ত্রীদিগকে ভোট দিতে দেওয়া হয় নাই, এইরুপ খবর আজ পর্যন্ত আমরা পাই নাই। শাসক শ্রেণী ভালোভাবেই জানেন যে; রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা পরিচালনার জন্য মিলিত হইয়া কাজ করা ছাড়া অন্য কোন পথ নাই। তাই মুখে বিভেদের বাণী যতই প্রচার করুক না কেন, উহা কেবল জনসাধারণের বেলায়।

 পাকিস্তানের সর্বত্রই যেখানে আজ যুক্ত নির্বাচন চালু রহিয়াছে, সেখানে জনগণকে সেই যুক্ত নির্বাচনের সুযোগ হইতে বঞ্চিত করা নিশ্চয়ই তাৎপর্যপূর্ণ। পাকিস্তান লাভের সাথে সাথে জনগণকে তখনকার শাসকগোষ্ঠী শিক্ষা দিয়াছেন যে, এদেশের জনগণ দুই জাতি-হিন্দু আর মুসলিম। একটি অত্যাচারী আর একটি অত্যাচারিত, এরা কোনদিনই এক হইতে পারে না। এই প্রচার জনগনের মনে সামকিয় বিভ্রান্তির সৃষ্টি করিয়া থাকিলেও তাহাদের শোষকদের চিনাইয়াছে। ট্যাক্রের জ্বালায় আর অনাহারে যাহারা মরিতেছে গুলী, জেলখানা যাহাদের মুখের ভাষা কারিয়া নিতেছে, দূর্গাপুরে যাহাদের বুকের রক্তে মাটি লাল হইয়াছে তাহারা সর্বহারা পাকিস্তানী। ব্যথা, দুঃখ আর সংগ্রাম সাধারণ মানুষের মধ্যে অত্যাচারীর বিরুদ্ধে লৌহদৃড় ঐক্য গড়িয়া তুলিয়া এই ঐক্য তাহাদের বিরুদ্ধে যাহারা জনগণকে প্রতারিত করিয়াছে, যাহারা জনগণকে অনাহারে মারিয়াছে, সোনার পাকিস্তানি যাহারা সর্বনাশ করিয়াছে সাধারণ মানুষের ঐক্য ধ্বংস করিয়া মানসে পৃথক নির্বাচনের নামে একটি অবাস্তব কল্পিত সমসর দিকে ধাবিত করার জন্যই শাসক শ্রেণীর এত উদ্যোগ আর আয়োজন। মাত্র নয় বৎসরের নূত জাতির পক্ষে এতবড় সাম্প্রদায়িক কলুষতার বিরুদ্ধে এত অল্প