পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (প্রথম খণ্ড).pdf/৭৮১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ প্রথম খন্ড
৭৫৬
বন্ধুগণ!

 স্বাধীনতা আমরা পাইয়াছি। আমাদের স্বাধীন বাসভূমি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে। দুনিয়ার কাছে সে স্বাধীনতার স্বীকৃতিও পাওয়া গিয়াছে। কিন্তু গত দশ বৎসরেও দেশবাসীর জীবনে কি সে স্বাধীনতার স্বীকৃতি লাভ ঘটিয়াছে? আপনারা শুনিয়া লজ্জিত হইবেন যে আজ পর্যন্ত গ্রামে এমন কথাও শোনা যায় যে দেশের অবস্থা প্রাকস্বাধীনতার আমলেই নাকি অধিকতর ভাল ছিল। পল্লী পরিভ্রমণে সে সত্য নির্মমভাবে চোখের সম্মুখে পরিস্ফুট হইয়া উঠে।

 পাকিস্তান একটি কৃষিপ্রধান দেশ। তার অর্থনীতির মূল ভিত্তি নিহিত কৃষকের জীবন আর কৃষকের জমিতে। বর্তমানে পৃথিবীর কৃষিপ্রধান কোন দেশের অগ্রগতিই সম্ভবপর নয়, যদি না দেশের কৃষি ব্যবস্থা সঠিকভাবে পরিচালিত হয়।

 আমাদের কৃষি ব্যবস্থা অতিশয় পশ্চাৎপদ। সেই মান্ধাতা আমলের ভাঙ্গা লাঙ্গল আর আধমরা গুরু আজিও পাকিস্তানের কৃষকের একমাত্র পুঁজি। অনাহারে অর্ধাহারে, সে আজ জীবন্মৃত। সরকারি হিসাব মতেই পূর্বপাকিস্তানের কৃষকের ভিতর শতকরা ৩৬ জন হইল ভূমিহীন এবং শতকরা ৪০ জন হইল গরীব কৃষক। এই হিসাব ১৯৪৮ সনের হিসাব। তারপর গত ৯ বৎসর উপর্যুপরি সংকটে আরো কত কৃষক যে জমিহারা হইয়াছে তাহার কোন হিসাব নাই। আমাদের এই প্রদেশের চাষীগণ দুনিয়ার সেরা পাট পয়দা করে; কিন্তু গত দশ বৎসরের ভিতর তাহার ন্যায্য মূল্য তাহারা পায় নাই। উত্তরবঙ্গের পটল, তামাক, দক্ষিণবঙ্গের মাদুর, পূর্ববঙ্গের বেত ও চাটাই শিল্প আজ মরোনোন্মুখ। ইহা ছাড়া, কৃষকের ট্যাক্স ও খাজনার বোঝা বাড়িয়াছে। অনাহার ও দুস্থতাই হইয়াছে আমাদের কৃষকদের নিত্যসঙ্গী এবং কৃষকের দুস্থতার ফলে কৃষি উৎপাদন দিন দিন কমিয়া চলিয়াছে। কৃষির উৎপাদন হ্রাস পাওয়ার ফলেই ঘুরিয়া ঘুরিয়া তীব্র খাদ্য সংকট আমাদের সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইতেছে। সুজলা সুফলা পূর্ব পাকিস্তান এবং শস্যভাণ্ডার বলিয়া বিখ্যাত, পশ্চিম পাকিস্তান আজ বিদেশী খাদ্য সাহায্যের উপর নির্ভরশীল হইয়া পড়িয়াছে।

 বিদেশ হইতে খাদ্য আমদানীতে আজ আমাদের বৈদেশিক তহবিলের বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় হইয়া যাইতেছে, দেশের শিল্পোন্নয়নে বিরাট অন্তরায় সৃষ্টি হইতেছে এবং ভিক্ষার ঝুলি হস্তে আমরা বিদেশের সাহায্য ভিক্ষা করিতেছি।

 মুসলিম লীগ, কৃষক শ্রমিক পার্টি, নেজামে ইসলাম প্রভৃতি সরকার কৃষকদের এই দুরবস্থার প্রতিকার করে নাই। আওয়ামী লীগ কোয়ালিশন সরকার প্রতিষ্ঠার পর কৃষকদের মনে নূতন আশার সঞ্চার হইয়াছিল। এই সরকার প্রথম দিকে কয়েকটি প্রসংশনীয় কাজ যথা, গত তীব্র খাদ্য সংকটের সময় লঙ্গরখানা খোলা, সমস্ত রাজবন্দীর মুক্তি, নিরাপত্তা আইন বাতিল এবং যুক্ত নির্বাচন প্রথা কায়েম করেন। সম্প্রতি এই সরকার সার্টিফিকেট প্রথা রদ করিবার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করিয়াছেন।

 কিন্তু কৃষকদিগের মৌলিক সমস্যা যথা, ভূমি সমস্যা, খাজনা সমস্যা, খাদ্য সমস্যা, বেকার কৃষকের নিয়োগ সমস্যা সমাধানে ব্যর্থতা দেখাইয়াছেন। সময় মত বিদেশ ও দেশের অভ্যন্তর হইতে খাদ্য সংগ্রহ, প্রতিটি মিউনিসিপ্যাল এলাকায় পূর্ণ রেশনিং, গ্রাম্য ঘাটতি এলাকায় সংশোধিত রেশনিং, মওজুত উদ্ধার প্রভৃতি ব্যবস্থাগুলি সময় মত অবলম্বন করেন নাই। ফলে প্রদেশে এখনও তীব্র খাদ্য সংকট বিরাট করিতেছে এবং গরীব কৃষক জনসাধারণের ঘরে অর্ধাহার ও অনাহার চলিতেছে। মুসলিম লীগ সরকার কর্তৃক রচিত ভূমিদখল ও প্রজাস্বত্ব আইনের যতাবিহিত সংস্কার না করিয়া এই সরকার ঐ আইন চালু করিতেছেন। ইহার ফলে গ্রামে গ্রামে সৃষ্টি হইয়াছে দুর্নীতিপরায়ণ আমলঅ আমিনদের অকথ্য জুলুম ও দুর্নীতির রাজত্ব। বিনা খেসারতে জমিদারী উচ্ছেদের সার্বজনীন দাবী সত্ত্বেও এই সরকার কৃষকদের ঘাড় ভাঙ্গিয়া জমিদারগণকে খেসারত দানের ব্যবস্থাই বহাল রাখিয়াছেন। এছাড়া ২১-দফা মোতাবেক খাজনা হ্রাস প্রাপ্ত হয় নাই, বরং বহুক্ষেত্রে খাজনা বৃদ্ধি হইতেছে।