পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (প্রথম খণ্ড).pdf/৭৮৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ প্রথম খন্ড
৭৫৯

বাস করিতে বাধ্য হয় যাহা মানুষের বাসোপযোগী নয়। বহু ক্ষেত্রেই শ্রমিক আইন ভঙ্গ করিয়া শ্রমিকদিগকে অতিরিক্ত খাটাইয়া লওয়া হয়। পাকিস্তানের শ্রমিকদের অবস্থা সত্যই অবর্ণনীয়।

 বর্তমানে নিত্যব্যবহার্য্য প্রতিটি দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি পাইয়াছে। এই অবস্থায় ২১ দফা ওয়াদা মোতাবেক শ্রমিকদের বেতন ও মাগগী ভাতা বৃদ্ধি করা আওয়ামী লীগ কোয়ালিশন সরকারের উচিত ছিল। কিন্তু তাহা করা হয় নাই। বরং বর্তমান পূর্ব পাকিস্তান সরকার শিল্পে শান্তি রক্ষার নামে এক চুক্তি সম্পাদন করিয়া শ্রমিকগণের বৈধ ধর্মঘটের অধিকার হরণ করিয়াছেন। কৃষকদের অবস্থা বর্ণনার সময় আমি বলিয়াছি এবং শ্রমিকদের ব্যাপারে পুনর্বার আমি সেই কথাই বলিতে চাই যে, আমাদের আযাদী লাভের দশ বৎসর অতীত হইয়া গেলেও পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের শ্রমিকদের জীবনে স্বাধীনতার ছোঁয়া লাগে নাই। কঠোর পরিশ্রম, মালিকদের জুলুম ও স্ত্রীপুত্রসহ কায়ক্লেশে জীবনধারণ ইহাই পাকিস্তানী শ্রমিকদের নসিব।

দুর্নীতি দমনে ব্যর্থতাঃ

 এরপর আসে দুর্নীতির কথা।

 স্বাধীনতা লাভের পূর্বেও দেশে দুর্নীতি ছিল। কিন্তু উহা অস্বাভাবিক ছিল না, কারণ বৈদেশিক সরকার বহু প্রকারের দুর্নীতির প্রশ্রয় দিয়া থাকে। তাহাদের শাসন কায়েম রাখার জন্য চাই দুর্নীতির আশ্রয় গ্রহণ। তাদের শোষণ কায়েম রাখিতে হইলেও প্রয়োজন দুর্নীতির। কাজেই শাসন ক্ষমতা হাতে রাখার এক বিরাট হাতিয়ার তাদের দুর্নীতি।

 উদাহারণস্বরূপ পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীদের কথা বলা যাইতে পারে। এই ‘মহান ব্যক্তিরা’ যে দেশেই গিয়াছেন সেখানেই দুর্নীতি বাসা বাঁধিয়াছে। তাদের আগমনও দুর্নীতিমূলক এবং তাদের অবস্থানও দুর্নীতিমূলক। আমেরিকার প্রিয় পাত্র চিয়াং কাইশেকের দেশ চীন একদা দুর্নীতিবাজদের আখড় হইয়া দাঁড়ায়। বৃটিশের অধীনে থাকাকালে ভারতেও দুর্নীতি প্রশ্রয় পায়। আজ বৃটিশ, আমেরিকা ও ফরাসীর যুক্ত অভিযানে গোটা মধ্যপ্রাচ্য দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হইয়াছে। যুদ্ধোত্তর জাপান ও তুরস্কও আমেরিকার কল্যাণে দুর্নীতিবাজির আখড়ায় পরিণত হইয়াছে।

 উত্তরাধিকার সূত্রে পাকিস্তানের শাসকগণও বৃটিশের নিকট হইতে দুর্নীতির পদ্ধতি আয়ও করেন। মুসলিম লীগ সরকার পাকিস্তানে দুর্নীতির পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেন। যুক্তফ্রণ্ট-লীগ কোয়ালিশন সরকারের আমলে উহা আরো প্রসারলাভ করে।

 আওয়ামী-কোয়ালিশন সরকার বহু ঢাকঢোল পিটাইয়া প্রচার করিয়াছিলেন তাঁহারা দুর্নীতির মূল্যোৎপাটন করিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। কিন্তু অবস্থা বর্তমানে এমন এক স্তরে আসিয়াছে যে, দুর্নীতি আজ প্রায় সমগ্র সমাজ-জীবনকে বিষাক্ত করিয়া তুলিয়াছে।

 দুর্নীতি দমন করা যায় না আমি একথা বিশ্বাস করিতে প্রস্তুত নই। সমাজ জীবন হইতে দুর্নীতি দূর করিতে না পারিলে পাকিস্তানের কোন উন্নতি হইতে পারে না। তাই সমাজ জীবন হইতে দুর্নীতি উৎখাত করিবার জন্য আমি সমস্ত পাকিস্তানবাসীর নিকট আকুল আবেদন জানাইতেছি।

 আমি বিশ্বাস করি যে, সরকার যদি উদ্যোগী হইতেন এবং উপযুক্ত ব্যবস্থা অবলম্বন করিতেন তাহা হইলে এদেশের সমাজ জীবন ও শাসনযন্ত্রকে তাঁহারা দুর্নীতিমুক্ত করিতে পারিতেন। কিন্তু সরকারী প্রচেষ্টারই অভাব রহিয়া গিয়াছে। তাই দুর্নীতিরোধ সম্পর্কিত সরকারের কথাবার্তা আজ অন্তসারশূন্য প্রমাণিত হইয়া গিয়াছে।