পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (ষষ্ঠ খণ্ড).pdf/১০৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

73 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ ষষ্ঠ খণ্ড করেছেন। সেদিক থেকে পরিণামে জামায়াত বা মুসলিম লীগের ভূমিকা থেকে এদের ভূমিকার আসলে খুব বেশী পার্থক্য নেই। একদল ধর্মের নামে বিরোধিতা করে, অপর দল প্রগতির নামে বিরোধিতা করে। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক-সকল অর্থেই বাংলাদেশকে পশ্চিম পাকিস্তানের কলোনী করে রাখা হয়েছিল। এখন প্রশ্ন হচ্ছে-অন্যান্য প্রগতিশীল ও সমাজবাদী অঙ্গীকার যদি অনুপস্থিতও থাকত তা হলে শুধু ঔপনিবেশিক শৃংখল থেকে বেরিয়ে আসার জন্যে যে মুক্তি সংগ্রাম কি ওই একটি কারণেই উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী মহলের সমর্থন লাভের দাবীদার হতো না? তা না হলে বলতে হয় যে, তাদের নির্দেশিত রাষ্ট্র কাঠামোর অঙ্গীকার যদি না থাকে তা হলে দেশ পরাধীনই থাক। এই নেতিবাচক ভূমিকা আত্মহননেরই সামিল। কিন্তু এই ধরনের মনোভাব যদি কেউ পোষণ করেন তা হলে বলতে হবে যে তারা নিঃসন্দেহে ভ্রান্ত। বিশেষ করে বাংলাদেশে মুক্তি সংগ্রামের ব্যাপারে। কারণ তা হলে বুঝতে হবে যে, জিন্না সাহেবের দ্বিজাতিতত্ত্বের মাথায় পদাঘাত করে বাংলাদেশে যে সাম্প্রদায়িক ক্লেদমুক্ত সাংস্কৃতিক ও ভৌগোলিক জাতীয়তার ভিত্তিতে সংগ্রাম চলছে তার সুদূরপ্রসারী গুরুত্ব ও প্রভাব তারা হয় অনুধাবন করতে পারেননি নয়তো হিসেবের মধ্যে আনেননি। তাছাড়া ঔপনিবেশিক শোষণ ও শাসনের বিরুদ্ধে জাতীয় মুক্তির লক্ষ্য অর্জনের জন্যে সশস্ত্র সংগ্রাম যে চরিত্রগতভাবে প্রগতিশীল সংগ্রাম হতে বাধ্য বিশেষ করে বিশ শতকের শেষ পর্যায়ে বিশ্বের সমাজ চেতনার পরিমণ্ডলে অবস্থান করে তাও হয়তো হিসেবের বাইরে রয়ে গিয়েছে। বিশ্ব শতকের শেষ ভাগে বর্তমান যুগের সমাজ চেতনার পরিচিত পরিমণ্ডলের মধ্যে বাংলাদেশের সর্বশ্রেণীর সমর্থনে ও সক্রিয় সহযোগিতায় যে মুক্তি সংগ্রাম চলছে সেই যুদ্ধের সফল পরিণতি কোন দিনই দেশী বাইশ পরিবার গড়ে উঠতে দেবে না। বাংলাদেশের সর্বশ্রেণীর সমন্বয়ে গঠিত মুক্তি যোদ্ধাদের রক্ত ক্ষরণের ভেতর দিয়ে যে সমাজ শক্তি ও সমাজ চেতনা দৃঢ়মূল হচ্ছে, সেই শক্তি ও চেতনাই সে ধরণের সম্ভাবনার পথ রুদ্ধ করবে। এ কথাও বুঝতে হবে যে, মুক্তিযোদ্ধারা ভাড়াটিয়া সৈন্য নয়। দেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষও শুধু শুধু জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ হয়নি। এর পেছনে অবশ্যই সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির সুনিশ্চিত আশ্বাস রয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেছেন যে, পশ্চিম পাকিস্তানী ২২ পরিবারের জায়গায় বাঙালী ২২ পরিবার সৃষ্টি করার জন্য তিনি এই মুক্তি সংগ্রাম শুরু করেননি। শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠাই ছিল তার মুক্তির সংগ্রামের লক্ষ্য। শুধু বঙ্গবন্ধুর মৌখিক ঘোষণাই নয়, আওয়ামী লীগের ম্যানিফেষ্টোতেও সামাজিক ন্যায়বিচার ও অর্থনৈতিক শোষণের হাত থেকে মুক্তির প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে। এই ঘোষণাপত্রের প্রথম দিকেই সংক্ষিপ্ত কয়েকটি কথায় জীবনের মৌলিক চাহিদা পূরণের নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে যে অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা, চিকিৎসা এবং উপযুক্ত পারিশ্রমিক কর্মসংস্থানের সুযোগসহ প্রতিটি নাগরিকের প্রাথমিক চাহিদা পূরণের মৌলিক দায়িত্ব রাষ্ট্রের এ কথার স্বীকৃতি শাসনতন্ত্রে থাকবে। রাষ্ট্রকর্তৃক জনগণের প্রাথমিক চাহিদা পূরণের মৌলিক দায়িত্ব রাষ্ট্রের বলে ঘোষণা করার সঙ্গে সঙ্গে উক্ত ঘোষণাকে বাস্তবে রূপায়িত করার জন্যে আওয়ামী লীগ ম্যানিফেষ্টোতে অর্থনৈতিক কর্মসূচীর ভিত্তিও ব্যাখ্যা করা হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে যে, শোষণমুক্ত একটি ন্যায় ও সাম্যবাদী সমাজ গঠন করাই এই অর্থনৈতিক কর্মসূচীর মূল লক্ষ্য। এটা একটা সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার রূপকল্প-যাতে অর্থনৈতিক অবিচার দূরিকরণ ও দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নতি সাধন করা হবে এবং দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ও সকল স্তরের মানুষের মধ্যে এই সমৃদ্ধির ফল যথাযথভাবে বন্টনের বিধান থাকবে। “শোষণমুক্ত ন্যায় ও সাম্যবাদী সমাজ গঠন ও সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক রূপকল্প বাস্তবায়িত করার জন্য আওয়ামী লীগের ম্যানিফেষ্টোতে ভাবী শাসনতন্ত্রে যে ব্যবস্থা সংবিধানে সন্নিবদ্ধ করার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে