পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (ষষ্ঠ খণ্ড).pdf/২০৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

167 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ ষষ্ঠ খণ্ড আইয়ুব খানের আমলে ভূমি ব্যবস্থার সংস্কার করা হয় উল্টা দিকে। এর আগে বাংলাদেশে মাথাপিছু জমির মালিকানার সর্বোচ্চ সীমা বা সিলিং ছিল ৩৩ একর বা ১০০ বিঘা। আইয়ুবী শাসনে তথাকথিত ভূমি সংস্কার’ আইনে বাড়াইয়া ৩৭৫ বিঘায় নির্ধারিত করা হয়। অথচ বাংলাদেশে জমির উপর জনসংখ্যার অতিরিক্ত চাপের পরিপ্রেক্ষিতে সিলিং নামাইয়া ৫০ বিঘা নির্ধারিত করা ছিল খুবই জরুরী। ১৯৫০ সালের জমিদারী দখল আইন এবং সিলিং সংক্রান্ত বিধি কিংবা পরবর্তীকালের আইয়ুব আমলের তথাকথিক ভূমি সংস্কার আইন যে কোন গরীব বা অর্থহীন কৃষক এক বিঘা জমিও পায় নাই। বাংলাদেশের শতকরা ৩৫ জন কৃষক ভূমিহীন এবং যাহাদের জমি আছে তাহদের মধ্যেও শকতরা ৭৮ জনের জমির পরিমাণ পাঁচ এর বা ১৫ বিঘার নিচে (বাংলাদেশের অনু্যন ১৫ বিঘা পরিমাণ জমিকে ইকনমিক হোল্ডিং ধরা হয়)। কাজেই ভুমি সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা যে কত জরুরী তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু এই জরুরী কাজটিই হয় নাই এবং না হওয়ার ফলে কৃষিতে সৃষ্টি হইয়াছে বন্ধ্যাত। অধিকাংশ জমির মালিক জমি চাষ করেন না আর যারা জমি চাষ করেন তাহারা জমির মালিক নন। ফলে কৃষির অগ্রগতির পথে এক দুস্তর বাধা সৃষ্টি হইয়াছে। আবার কৃষি ব্যবস্থার আধুনিকীকরণ তথা কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির মারফত কৃষকের হাতে পয়সা না আসার ফলে শিল্পজাত পণ্যের বাজারও রহিয়া গিয়াছে সঙ্কুচিত অবস্থায় এবং শিল্প বিকাশের সম্ভাবনা হইয়াছে খর্ব। এই অবস্থায় অর্থনৈতিক উন্নতির আশা ছিল সুদূর পরাহত। আজ যখন বাংলাদেশের সংগ্রাম সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে তখন দেশের অর্থনৈতিক রূপরেখায় ভূমি সংস্কার তথা কৃষি পুর্ণর্গঠনের কর্মসূচীকে আর ফেলিয়া রাখা যায় না। ইহার স্থান হওয়া উচিত অর্থনৈতিক পুনর্গঠন কর্মসূচীর একেবারে পয়লা নম্বরে। পারিবারিক মালিকানাধীন জমির সিলিং কমাইয়া উর্ধ্বপক্ষে ১০০ বিঘা নির্ধারিত করা, উদ্ধৃত্ত জমি গরীর কৃষক ও ভূমিহীনদের মধ্যে বিনামূল্যে বিলি করা, ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির মালিকদিগকে খাজনা হইতে অব্যাহতি দেওয়া, খাজনা প্রথা ধীরে ধীরে উঠাইয়া দিয়া কৃষি আয়কর চালু করা, ইজারাদারী জলমহাল, বনমহল প্রভৃতি সামন্তবাদী শোষণের অবশেষ গুলিকে বিলুপ্ত করা, সমবায় কৃষি শুধ অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের তাগিদে নয়, স্বাধীনতার লড়াইয়ে কৃষকদিগকে অধিকতর সংখ্যায় উদ্বুদ্ধ করার জন্যও মুক্তি সংগ্রামের একটি প্রধান রণধ্বনি হওয়া উচিতঃ কৃষকের হাতে জমি দাও। বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতা হইতেও আমরা এই শিক্ষাই পাইতে পারি। কৃষকের হাতে জমি দেওয়ার ভিত্তিতে মুক্তাঞ্চলগুলিতে ভূমি সংস্কারের কাজে এখনই হাত দেওয়া উচিত। মুক্তাঞ্চলে এই দৃষ্টান্ত স্থাপন করিতে পারিলে অধিকৃত এলাকার কৃষকগণও মুক্তি সংগ্রামে অধিকতর অনুপ্রাণিত হইবেন। সাম্রাজ্যবাদী শোষণের অবসান ঘটান রাজনৈতিক পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে আর একটি জরুরী কাজ। সোনার বাংলা যে আজ শ্মশান, তার পিছনে করাচী-লাহোরের একচেটিয়া পুঁজিপতিদের সাথে সাথে সাম্রাজ্যবাদী বিশেষতঃ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী শোষণের অবসান কম নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ঋণের সুদ বাবদই প্রতি বৎসর °の-brの কোটি টাকা পাকিস্তান হইতে লুটিয়া নিত, উহার সিংহভাগ যাইত পূর্ব বাংলা হইতে। অতীতে দেশবাসীর দৃষ্টি এদিকে যথেষ্ট পরিমাণে সজাগ ছিল না। পূর্ব বাংলারূপী চৌবাচ্চাতে দুইটি ছিদ্র ছিল একটি করাচী-লাহোরের একচেটিয়া পুঁজির শোষণের আর অন্যটি সাম্রাজ্যবাদী তথা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী শোষণের বাংলাদেশের সম্পদ পাঁচার বন্ধ করিতে হইলে এই দুইটি ফুটোই বন্ধ করা দরকার। এ ব্যাপারে সরকারের কর্মসূচী হওয়া উচিতঃ (১) অতীতে পাকিস্তানকে দেওয়া ঋণের সমুদয় দায়িত্ব অস্বীকার করা; (২) বাংলাদেশে সাম্রাজ্যবাদী পুঁজি বিনা ক্ষতি পূরণের জাতীয়করণ করা (চা-শিল্প ব্যাংক, বীমা ও রপ্তানী বাণিজ্যে সাম্রাজবাদী পুঁজি রহিয়াছে); এবং (৩) ভবিষ্যতে সাম্রাজ্যবাদী পুঁজির অনুপ্রবেশের পথ বন্ধ করা।