পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (ষষ্ঠ খণ্ড).pdf/২০৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

172 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ ষষ্ঠ খণ্ড শিরোনাম সংবাপত্র তারিখ সম্পাদকীয়ঃ মুক্তিযুদ্ধ ১২ ডিসেম্বর, ১৯৭১ জাতীয় জীবনের এই পরম লগ্নে ১ম বর্ষঃ ২৩শ সংখ্যা সম্পাদকীয় জাতীয় জীবনের এই পরম লগ্নে আট মাসের এবং বলিতে গেলে ২৪ বৎসরের অমানিশার পরে বাংলাদেশের আকাশে আজ নবঅরুণোদয় ঘটিতেছে। পাকিস্তানের মুষ্টিমেয় একচেটিয়া পুঁজিপতি ও বৃহৎ সামন্তবাদী ভূস্বামীদের জাতিগত নিপীড়ন ও শোষণ এবং তার সাথে মার্কিনী পুঁজির নয়া ঔপনিবেশিক জাঁতাকলে নিষ্পেষিত বাংলাদেশের শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র, মধ্যবিত্ত তথা গোটা বাঙালী জাতি নিজেদের ন্যায্য জাতীয় ও গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য গত ২৪ বৎসর বহু গৌরবময় সংগ্রাম করিয়াছেন। গত ২৫শে মার্চের পর জনগণের এই ন্যায্য সংগ্রামই ইয়াহিয়া চক্রের বর্বর বাহিনীর বিরুদ্ধে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের জন্য সশস্ত্র সংগ্রামের রূপ পরিগ্রহণ করিয়াছে। মাতৃভূমির স্বাধীনতা ও জাতীয় মুক্তির জন্য জনগণের এই বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম আজ সাফল্যের দ্বারে আসিয়া উপনীত হইয়াছে ঘৃণ্য দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে কৃত্রিমভাবে রচিত প্রতিক্রিয়াশীল পাকিস্তান রাষ্ট্র আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের আঘাতে আজ ভাঙ্গিয়া পড়িতেছে। দুনিয়ার বুকে জন্ম নিয়াছে এক নবীন রাষ্ট্র-গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। প্রতিক্রিয়াশীল সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র পাকিস্তানের অভিশাপ হইতে বাঙালী জাতি আজ মুক্ত হইতেছে। আমাদের এই স্বাধীনতা সংগ্রামকে স্তব্ধ করার জন্য নরঘাতক ইয়াহিয়া চক্র গণহত্যা, পাইকারী নারী ধর্ষণ, গৃহদাহ, লুন্ঠন প্রভৃতি কোন অপরাধমূলক কাজই বাকি রাখে নাই। কিন্তু, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ তাতে দমিত হওয়ার বদলে আরও দুর্বার হইয়াছে। দুর্ধর্ষ মুক্তিবাহিনী ও গেরিলা বাহিনীর প্রচণ্ড- মারের চোটে দিশাহারা হইয়া ইয়াহিয়া চক্র অবশেষে আমাদের দেশে মার্কিনী হস্তক্ষেপ ডাকিয়া আনার জন্য পাক-ভারত যুদ্ধ বাধাইয়াছে। ইয়াহিয়া চক্রকে বাঁচাইবার জন্য মার্কিনী সাম্রাজ্যবাদীরাও এই যুদ্ধের সুযোগে নিরাপত্তা পরিষদের মাধ্যমে আমাদের দেশে হস্তক্ষেপের চেষ্টা করিয়াছিল। সমাজতন্ত্রের দাবিদার চীনও সমাজতন্ত্রের নীতি হইতে বিচ্যুত হইয়া নরঘাতক ইয়াহিয়া চক্রের পক্ষ নিয়া মার্কিনী সাম্রাজ্যবাদের ঐ চক্রান্ত সমর্থন করিয়াছিল। কিন্তু, দুনিয়ার নিপীড়িত জাতিসমূহ ও জনগণের অকৃত্রিম বন্ধু মহান সোভিয়েত ইউনিয়ন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও চীনের সে চক্রান্ত জাল ছিন্নভিন্ন করিয়া দিয়া আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সাফল্যে এক বিরাট অবদান রাখিয়াছে। পক্ষান্তরে ইয়াহিয়া চক্রের আগ্রাসী আক্রমণের বিরুদ্ধে ভারত সরকার প্রতিরক্ষার জন্য যে পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণ করিয়াছেন, তাতে বাংলাদেশে ঐ খুনীর দলের অন্তিম দশা উপস্থিত হইয়াছে। ভারত সরকার বাংলাদেশ দিয়াছেন। আমাদের মুক্তিবাহিনী ও মিত্র ভারতীয় বাহিনীর যৌথ আক্রমণে বাংলাদেশে শত্রর ঘাটিগুলির একটার পর একটা দ্রুত পতন ঘটিতেছে। নিরস্ত্র মানুষকে পাইকারী হত্যা, অসহায়া নারীকে ধর্ষণ ও এক কোটি নরনারীকে দেশছাড়া করিয়া যে নরপিশাচরা একদা বীরত্ব দেখাইয়াছিল, আজ মুক্তিবাহিনী ও মিত্র বাহিনীর দুর্বার অগ্রগতির সামনে তারা প্রাণভয়ে পলায়ন করিতেছে। বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ এলাকা ইতিমধ্যেই শত্রর কবল হইতে মুক্ত হইয়াছে। সে শুভদিনও আজ আর বেশী দূরে নয়, যেদিন ঢাকার সরকারী দপ্তরেও স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড্ডীন হইবে। বাঙালী জাতির জীবনে আজ নতুন দিন আগত।