পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (ষষ্ঠ খণ্ড).pdf/২৭২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

236 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ ষষ্ঠ খণ্ড বাহিনী যে গণহত্যাযজ্ঞ শুরু করে সম্ভবতঃ উহারই অগ্রিম আভাস পাইয়া উথান্ট তৎপূর্বে ঢাকায় কর্মরত জাতিসংঘের কর্মচারীদের ঢাকা ত্যাগের অনুমতি প্রদান করেন। এই সময় বঙ্গবন্ধু উথান্টকে উদ্দেশ্য করিয়া বলিয়াছেন, “জাতিসংঘের কর্মচারীদের ঢাকা ত্যাগের অনুমতি দানের মধ্যে জাতিসংঘ সেক্রেটারী জেনারেলের কর্তব্য শেষ হইয়া যায় না। শক্তিমত্ত জঙ্গী শাসকের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের প্রতি জাতিসংঘের যে দায়িত্ব রহিয়াছে উহা বিস্মৃত হইলে চলিবে না।” কিন্তু ইহাতেও জাতিসংঘের চৈতন্যোদয় হয় নাই। যদি হইত বাংলাদেশে মানব সভ্যতার ভয়াবহতম ট্রাজেডির বিভীষিকা সম্ভবতঃ অপেক্ষাকৃত কম হিংস্রতা লইয়া দেখা দিতে পারিত। তারপর বহুদিন কাটিয়া গিয়াছে। বাংলাদেশে জল্লাদ ইয়াহিয়ার নরমেধযজ্ঞ চলিয়াছে অব্যাহত গতিতে, বিপন্ন মানবতা অসহায় আর্তনাদে বার বার মুখ থুবড়িয়া পড়িয়াছে বাংলার রক্তপিচ্ছিল মাটিতে। ইয়াহিয়া খান-বাঙ্গালী জাতিকে নিশ্চিহ্ন করার উদ্দেশ্যে ভয়াবহতম গণহত্যা অভিযান চালাইয়াই ক্ষান্ত হয় নাই, মাতিয়া উঠিয়াছে বঙ্গবন্ধু মেখ ভয়াল গর্জন হইয়া ফাটিয়া পড়িয়াছে বার বার। কিন্তু তবু জাতিসংঘ নামক কুম্ভকর্ণের নিদ্রাভঙ্গ হয় নাই। স্বাধীনতার সংগ্রামে লিপ্ত বাংলার নেতা ও জনতার প্রতি স্বীয় দায়িত্ব পালনে জাতিসংঘ অগ্রণী হইয়া আসে নাই। বরং উল্টা হানাদার জঙ্গীশাহীর সুবিধাজনক অনুরোধে বিগলিত হইয়া বাঙ্গালী জাতির মুক্তিসংগ্রাম বিঘ্নিত ও বানচাল করার জঘন্য উদ্দেশ্য সাধনের নিমিত্ত ভারত বাংলাদেশ সীমান্তে জাতিসংঘ পর্যবেক্ষক নিয়োগের অবাঞ্চিত উদ্যোগ গ্রহণ করিয়া বিশ্বসংস্থা হিসাবে নিজের গৌরবমণ্ডিত ছবিটাকেই তস্করবৃত্তির কলংক কালিমালিপ্ত করিয়া তুলিয়াছে। বুঝিতে কষ্ট হইবার কথা নয় যে, কঙ্গোর লুমুম্বা ট্রাজেডির নেপথ্য নায়ক, ভিয়েতনামে অন্যায় যুদ্ধের ঘৃণিত দসু্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ইঙ্গিতেই জাতিসংঘ বাংলাদেশের প্রশ্নে স্বীয় দায়িত্ব পালনে ইচ্ছাকৃত ব্যর্থতার পরিচয় দিয়াছে। আর এই ব্যর্থতা বাংলাদেশের মানুষের সামনে, বিশ্বের শান্তিকামী মানুষের সামনে জাতিসংঘকে লক্ষ্যচু্যত একটি কার্যকারিতাবিহীন রাজনৈতিক আড্ডাখানা হিসাবেই উপস্থাপিত করিয়াছে। এই পরিস্থিতির পটভূমিতেই আজ জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশন বসিতেছে। জাতিসংঘের মানবতার নামে এই বিশ্বসংস্থার প্রতি আকুল আবেদন জানাইতেছি, মানুষের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব মানবিক মূল্যবোধ আর মানবজাতির প্রতি যদি উহার বিন্দুমাত্রও আস্থা এবং দায়িত্ব থাকিয়া থাকে তবে এখনও সময় আছে। সমস্ত শক্তি লইয়া জাতিসংঘকে বাংলাদেশের পার্শ্বে আসিয়া দাঁড়াইতে হইবে সমস্ত শক্তি লইয়া রুখিয়া দাঁড়াইতে হইবে হানাদার পশ্চিম পাকিস্তানী উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে। পৃথিবীর দিক-দিগন্ত হইতে যেসব দেশ ও জাতি আজ নিউইয়র্কে আসিয়া জাতিসংঘ সদর দফতরে বৈঠকে মিলিত হইতেছেন, তাহদের কাছে মাতৃভূমির স্বাধীনতা রক্ষার জীবনপণ সংগ্রামে লিপ্ত, সাড়ে ৭ কোটি বাঙ্গালীর পক্ষ হইতে আমাদের একটি মাত্রই বক্তব্য আছে। বাংলাদেশে কি ঘটিয়াছে আপনারা জানেন। তাই যদি সভ্যজাতি বলিয়া দাবী করিতে চান, যদি গণতন্ত্র স্বাধীনতা ও মানবতায় বিশ্বাসী বলিয়া নিজেদের পরিচয় অক্ষুণ্ণ রাখিতে চান, তবে জাতিসংঘের এই অধিবেশনকালে একটি মাত্র পথই আপনাদের সামনে খোলা আছে। আর তাহা হইতেছে সকলের ঐক্যবদ্ধ চাপের দ্বারা ইয়াহিয়ার জিন্দাখানা হইতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ছিনাইয়া আনা এবং স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়া জাতিসংঘে বাংলাদেশকে পৃথিবীর নবীনতম রাষ্ট্র হিসাবে আসন প্রদান করা। এইবারও যদি আপনারা বাঙ্গালী জাতির প্রতি দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হন, ইতিহাস আপনাদের চিহ্নিত করিবে মানবতা ও স্বাধীনতার দুশমন হিসাবে আর জাতিসংঘ পরিণত হইবে ব্যর্থ লীগ অব নেশনসের প্রেতাত্মায়।