পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (ষষ্ঠ খণ্ড).pdf/৩৫১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

315 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ ষষ্ঠ খণ্ড পাকিস্তানের সর্বমোট সৈন্যসংখ্যা প্রায় ৩ লক্ষ। এর মধ্যে ওদের শাদাদী বেহেশতখানা ইসলামাবাদ, লাহোর ইত্যাদি শহরগুলো এবং পশ্চিম পাকিস্তানের সীমান্ত এলাকা রক্ষা ও পাঠান-বালুচ সিন্ধীদের বিদ্রোহ দমনের জন্য ২ লক্ষ ২৫ হাজার সৈন্য ওখানে মোতায়েন রাখতে হয়েছে। বাংলাদেশে এনেছিল ৭৫ হাজার। কিন্তু ইতিমধ্যে ২৭ হাজার হয়ে গেছে খতম। অবশিষ্ট ৪৮ হাজার বাছাধনেরা বিগত ৫ মাসের অনবরত যুদ্ধের মধ্যে বার শত মাইল দূরে মা বোনদের হাতে বাংলার লুষ্ঠিত টাকা, অলংকার ও অন্যান্য দ্রব্যাদি সমজায়ে দিয়ে আসা তো দূরের কথা লুষ্ঠিত সামগ্রী কোমরে ও পেটে বেঁধে রেখে মূহুর্তের জন্যও একবার বিশ্রামের সুযোগ পাচ্ছে না। দেশে যাওয়ার রাস্তাটাও বিপদসঙ্কুল। মুক্তিফৌজের চতুর্দিকে আক্রমণ তাদেরকে ঘাঁটিগুলো কড়া পাহারায় রেখেছে। পালিয়ে যাওয়ার সময় ওরা কিন্তু বাংলাদেশের সকল দালাল ও বিহারী গুণ্ডাদেরকে মুক্তিফৌজের গুলির নিশানায় তাদের সকল পাপের কাফফারাস্বরূপই ফেলে যাবে। ভারত থেকে মার খাওয়া কালো চামড়ার যে বিহারীগণ পশ্চিম পাকিস্তানে মাথা গুজাবার ঠাইও পায়নি পৃথিবীর সব চাইতে ঘনবসতি অঞ্চল এই পূর্ব বাংলায় আমরাই ওদেরকে ভাই বলে স্থান দিয়েছিলাম। চাকুরী, ব্যবসা, এমন কি ক্ষেত খামারে পর্যন্ত অংশীদার করেছিলাম। কিন্তু সেই চরম বিশ্বাসঘাতকেরাই বাংলার মাটির সঙ্গে করেছে বেঈমানী, নিমকহারামী এবং বাংলার মানুষের উপর করেছে অকথ্য অত্যাচার। বাংলাদেশের ব্যাপারে দুনিয়ার জনমত আজ পাকিস্তানের নিন্দায় মুখর। নিরস্ত্র জনসাধারণ এবং বিশেষ করে নারী শিশুদের প্রতি পাক-সামরিক বাহিনী যে চরম অত্যাচার করছে দুনিয়ার ইতিহাসে তার কোন নজীর নেই। এসব কুকীর্তি আজ পৃথিবীর মানুষের অজানা নয়। তাই বিশ্বের সকল জায়গা থেকেই ওদেরকে ধিক্কার দেওয়া হচ্ছে এবং সেই জন্যই কুখ্যাত জল্লাদ টিক্কা খাঁকে বাংলা মুলুক থেকে সরিয়ে নিয়ে পাঠান, বালুচ ও সিন্ধীদেরকে শায়েস্তা করার ভার ওর উপর দিয়েছে ইয়াহিয়া খাঁ। কারণ ওখানকার জনমতও আজ বিক্ষুব্ধ। ভুট্টো সাহেব কন্ধে পাচ্ছেন না। আর্থিক দিক দিয়েও পশ্চিম পাকিস্তানের অবস্থা কাহিল। পাকিস্তানের সর্বমোট আয়ের প্রতি তিন টাকার দু টাকা ছিল বাংলাদেশের পাট, চা, তামাক ও বিলাত প্রবাসী বাঙালীদের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা। মুক্তিযুদ্ধের ঠেলায় দু টাকার স্থলে আট আনাও এখন তাদের কপালে জুটছে না। বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের বাজারে পশ্চিম পাকিস্তানের কাপড়ের মিলগুলো তাদের তৈরী কাপড় বিক্রী করতে না পারায় মিলগুলোতে তালা চাবী লাগাতে বাধ্য হচ্ছে। বেতন দিতে না পারায় পাঞ্জাবী মিল শ্রমিকদেরকে পাইকারীভাবে চাকুরী হতে বরখাস্ত করা হচ্ছে করাচীর বাজারের আমদানীকারক ও বড় বড় ব্যবসায়ীদের তেলতেলীভাব আজ আর নেই। মোগলাই মেজাজ ভোতা হয়ে যাচ্ছে। চব্বিশ বছরে গঠিত বাইশ পরিবারের শোষণের ভিত ভেঙ্গে আজ চুরমার হয়ে যাছে। সিপাহীদের যুদ্ধকালীন অতিরিক্ত ভাতা হয়ে গিয়েছে বন্ধ। বাংলাদেশে নিয়োজিত সিপাইদেরকে আপাতত ঘুষের টাকা, লুষ্ঠিত ঘড়ি, অলংকার ইত্যাদি ও বদমায়েশীর আবাদ লাইসেন্স দিয়েই খুশী রাখার চেষ্টা চলছে। বেতন ও ভাতা দিবে কোন টাকশাল? আল্লাহর মেহেরবানীতে করাচী ও ঢাকার দুরত্ব দিন দিনই বৃদ্ধি পাচ্ছে। ভারতের উপর দিয়ে আগে ছিল ১২০০ মাইল আর এখন ভারত ঘুরে ও হাজার মাইল পাক-ভারত যুদ্ধ বাধলে এই দূরত্বের মাত্রা দাঁড়াবে ৭ হাজার মাইলের বেশী। আপনারা তখন যাবেন বঙ্গোপসাগরে-আর ঐ পশ্চিমা দসু্যরা ডুবে মরবে আরব সাগরে।