পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (ষষ্ঠ খণ্ড).pdf/৩৬৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

331 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ ষষ্ঠ খণ্ড ভাসবদিতকদতাকদবাংলাদেশের ব্যাপারে দ্বিতীয় বার চিন্তা করা যাবে। তাই বাংলাদেশের এই মুহুর্তে চৈনিক সমর্থনের আশা করা বৃথা। রাশিয়া বাংলাদেশের ব্যাপারে সহানুভূতি দেখানো আর সক্রিয় সমৰ্থন করা এক কথা নয়। রাশিয়ার বর্তমান স্ট্র্যাটেজিই হলো কারো সাথে প্রত্যক্ষ সংঘাত এড়িয়ে চলা। মোট কথা কোন বেদেশী শক্তি যে আমাদের জন্য বড় রকমের কিছু করে বসবেন সেই সম্ভবনা আদৌ কিছু দেখা যাচ্ছে না। বাংলাদেশে সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু হওয়ার পর অনেকেই ভাবতে শুরু করেছিলেন যে নিজেদের ভেতরের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমস্যার চাপেই ইয়াহিয়া সরকার ভেঙ্গে পড়বে। কিন্তু তা মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর মধ্যে বিরাট মতবিরোধের যে কথা এতদিন বলা হচ্ছিল তার অস্তিত্ব আছে বলে হনে হয় না। তবে মুক্তিবাহিনীর হাতে ব্যাপকভাবে নিজেদের লোক হতাহত হওয়ার ফলে নিম্ন পর্যায়ের সামরিক অফিসারদের মধ্যে কিছুটা মনকষাকষি দেখা দিতে পারে। পশ্চিম পাকিস্তানের ভুট্টোই এখন ইয়াহিয়া সরকারের অন্যতম রাজনৈতিক সমস্যা। তিনি ঘন ঘণ ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবী জানাচ্ছেন। তাঁর দলই এখন জাতীয় পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠ। সুতারং পাকিস্তান শাসন করার অধিকার তাঁরই। ইয়াহিয়া খান কিন্তু এখন ক্ষমতা ছাড়তে রাজী নন। তিনি কাউন্সিল মুসলিম লীগ ও কনভেনশন মুসলিম লীগের সংযুক্তি ঘটিয়ে তাঁর অনুগত একটি দল গঠনে সমর্থ হয়েছেন। বাংলাদেশে পুনঃনির্বাচন প্রহসন চালিয়ে তিনি এই দলকেই ক্ষমতায় আনতে চাইছেন। উপরন্তু ভুট্টো সাহেবের দল এখন প্রায় দ্বিধাবিভক্ত। ওয়ালী খান কাবুল পালিয়ে গেছেন। তাঁর দলের অনেকেই এখন বন্দী। বিগত নির্বাচন ও তার পরবর্তী রাজনীতির ধারা দেখে মনে হয় না, তিনি এমন কিছু করতে পারবেন যা ইয়াহিয়া খানের কাছে মারাত্মক হতে পারে। বহু রাষ্ট্রই প্রকাশ্য ও গোপনে পাকিস্তানকে অর্থ ও অস্ত্র সাহায্য দিচ্ছে। তাছাড়া বাংলাদেশ থেকে প্রায় এক কোটি শরণার্থী হয়ে ভারতে চলে যাওয়ায় আর্থিক চাপও কিছুটা লাঘব হয়েছে। বাংলাদেশে উৎপাদন যেমন বন্ধ, উন্নয়নমূলক কাজও তেমনি বন্ধ। মোট কথা পাকিস্তান তার ভিতরকার রাজনৈতিক আর অর্থনৈতিক চাপ সহ্য করতে না পেরে আপনা থেকেই কেটে বলে যে ধারনা আমরা করেছিলাম, তা সহসা বাস্তবায়িত হতে যাচ্ছে না। আমরা এখন পাকিস্তানের ইয়াহিয়া সরকারের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত। এ যুদ্ধে জয়-পরাজয়ের উপর নির্ভর করে বাঙালী জাতির অস্তিত্ব। সুতরাং আমাদের স্ট্র্যাটেজি নির্ধারণের ব্যাপারে একটা ভাবাবেগকে সামনে রাখলে আমরা ভুল করবো। আমরা নিজেদের অভিজ্ঞতা দিয়ে দেখেছি কোন বিদেশী রাষ্ট্রের চাপ নয়, নিজেদের কোন আত্মকহল নয় বরং বাংলার মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচণ্ড আক্রমণই পশ্চিম পাকিস্তানী ইয়াহিয়া সরকারকে দিন দিন কাবু করে আনছে। আর এটা অত্যন্ত পরিস্কার কথা, যে পথে চললে ফল পাওয়া যায় সে পথে চলাই বুদ্ধিমানের কাজ। দেশে ঘুরে পাকিস্তানের উপর চাপ সৃষ্টির জন্য হাতে পায়ে ধরে বেড়ানোর চেয়ে অথবা নিজের দেউলেপনায় অসহায় হয়ে কবে আমাদের ডেকে নিয়ে পাকিস্তান স্বাধীনতা বুঝিয়ে দেবে তার অপেক্ষায় বসে থাকার চেয়ে মুক্তিযুদ্ধ তীব্রতর করার দিকেই এখন সমস্ত যুক্তি কেন্দ্রীভূত করা উচিত। ভিক্ষুকের মনোবৃত্তি নিয়ে অপরের সাহায্যের আশায় বসে না থেকে যেদিন আমরা আত্মশক্তিতে বলীয়ান হয়ে উঠব, একমাত্র সেদিনই দেশ থেকে শক্রদের চিরতরে বিতাড়িত করা যাবে। বিশ্বের ইতিহাস প্রমাণ করেছে ভিক্ষার মাধ্যমে কোন জাতির কোন ন্যায্য দাবী আদায় হয়নি। সার্বিক মুক্তির জন্য প্রয়োজন সর্বাত্মক সংগ্রাম। -সঞ্জীব চৌধুরী