পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (ষষ্ঠ খণ্ড).pdf/৩৮২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

346 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ ষষ্ঠ খণ্ড গীর্জা কিছুই রক্ষা পায় নাই। মৃত্যু আর ধ্বংসের তাণ্ডবলীলার মধ্যে স্বাধীনতা সংগ্রাম চালাচ্ছে আজকের বাংলাদেশ। জঙ্গী বাহিনী মানবতাকে হত্যা করে, ন্যায়নীতিকে বলি দিয়ে , ধর্মের আদর্শকে পদদলিত করে, মুক্তিকামী জনগণের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এক বিভীষিকার রাজত্ব চালিয়েছে। যার নজীর মধ্যযুগেও বিরল। নাদির শাহ তৈমুর বা চেঙ্গিশের নৃশংসতাকেও লজ্জা দিয়েছে পাকবাহিনীর বর্বরতা। এত চোখের জল ঝরেছে যার নজীর বিংশ শতাব্দীতে খুব বিরল। বাঙালীর অপরাধ তারা স্বাধীনতা চায়, সর্বপ্রকার বিদেশী শোষণের নাগপাশ থেকে মুক্তি পেতে চায়। বাঙালী জাতি সেই মুক্তিসংগ্রামে অবতীর্ণ- এ সংগ্রাম বাঙালীর বাঁচার সংগ্রাম; এই পৃথিবীতে তারা স্বাধীন সার্বভৌম জাতি হিসেবে বাঁচতে চায়। বাংলার ভাষা, বাংলার কৃষ্টি, ইতিহাস, অর্থনীতি, সবই আলাদা, স্বতন্ত্র। এই বাঙালী তাদের নিজস্ব দেশ, আবাসভূমি এই পৃথিবীর মানচিত্রে একে দিতে চায়। কোন বিদেশী বহিরাগত জালেমদের শাসন বাঙালী মানতে চায় না, মানতে পারে না কোনদিন। বাংলার ক্ষেতখামার, নদনদী, জলবায়ু, বন-জঙ্গল, শহরগ্রাম, ঘরবাড়ী, অট্টালিকা, কলকারখানার সমুদয় সম্পত্তির মালিক বাংলার জনসাধারণ। তাতে সকলের সমান অধিকার। বাঙালী আমাদের ভাই, আমাদের বন্ধু, আমাদের আপনজন- তারা স্বদেশে বিদেশে যেখানেই বাস করুক না কেন। বাঙালীর সুখে আমরা সুখী, তাদের দু:খে আমরা দুঃখী, ব্যথায় ব্যথিত, সকলের তরে সকলে আমরা। বাঙালীর রক্ত এক ও অভিন্ন বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম- সমগ্র বাঙালী জাতির মুক্তি সংগ্রাম। এ বাংলা নেতাজি সুভাষের পিতৃভূমি, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের জন্মভূমি, রবীন্দ্রনাথের কবিতার উৎস, নজরুলের শৈশবের লীলাভূমি, আচাৰ্য প্রফুল্লচন্দ্র, জগদীশ বসু, মেঘনাদ সাহার জন্মস্থান, বিপ্লবী শহীদ সূৰ্য্য সেন , প্রীতিলতা, প্রফুল্ল, তীতুমীর, শহীদ বরকত, সালাম, আসাদ, সার্জেণ্ট জহুরুল, রওশনারা ও অন্যান্য মুক্তিকামী, বীর সন্তানদের আত্মত্যাগের মহিমায় উজ্জল, ভাস্বর এক অপরূপ দেশ। যারা আমাদের ২৩ বছর ধরে অবিরাম শোষণ করেছে। নির্মম শাসনেই ষ্টীমরোলার চালিয়েছে, তাদের প্রতি কোন দয়া নাই, যারা লক্ষ লক্ষ মানুষের রক্তে বাংলার মাটি লাল করে দিয়েছে, তাদের সংগে কোন আপোষ নাই। যারা মা বোনের মান সম্ভব ভূলষ্ঠিত করেছে তার প্রতিশোধ আমাদের নিতে হবেই। বাংলার শিশুদের আর্তক্ৰন্দন, বৃদ্ধের দীর্ঘ নিঃস্বাস, মা বোনের চোখের জল আমাদের মোছাতেই হবে। গৃহ-হারাদের বেদনার বোঝা বইতে হবে না। মা বোনদের মুক্তির দিন আগত। মনে বহু ব্যাথা আছে, বেদনা আছে, অনেক দুঃখ জমা হয়ে আছে প্রতিটি হৃদয়ে। আছে প্রতিহিংসার আগুন যে আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যাবে পশ্চিম পাকিস্তানী শাসক, শোষক, ধনি, বণিক, সওদাগরের পৃষ্ঠপোষিত সামরিক সরকার। যে সমস্ত বীর যোদ্ধারা কোনদিন । কিন্তু তাদের জীবনের ত্যাগের বিনিময়ে কি পাব আমরা আমাদের নিজের দেশ, দুঃখী বাংলাকে ত্যাগ, দুঃখ, কষ্ট, রক্তদান ছাড়া স্বাধীনতা সংগ্রাম হয় না-হতে পারে না। তাই আমাদের আহবান, যত বেশী ত্যাগ ও যত বেশী রক্ত দেব তত তাড়াতাড়ি আমাদের জয়ের দিন এগিয়ে আসবে। রক্ত দিতে শিখেছে বাংলার কৃষকেরা, কারখানার শ্রমিকেরা, স্কুল কলেজের ছাত্ররা, ত্যাগ স্বীকার করতে শিখেছেন বাংলার মা বোনের, দুঃখ বরণ করতে শিখেছে বাংলার শিশুরা । তাই স্বাধীনতার দিন নতুন বাংলার দিন আগত। জয় আমাদের অবশ্যম্ভাবী।