পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (ষষ্ঠ খণ্ড).pdf/৪৯৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

460 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ ষষ্ঠ খণ্ড বলে দেয়। এ নিয়ে গবেষণার প্রয়োজন পড়ে না। আর তাই আমরা দেখি-আমেরিকা তার তাঁবেদারদের দিয়ে সবকিছু ভুলে গিয়ে একটা রাজনৈতিক আপোষ-মীমাংসার কথা বিভিন্ন সময়ে বারবার উত্থাপন করেছে। কিন্তু বাংলাদেশের সরকার, বাংলাদেশের সংগ্রামী জনতা তা বারবার প্রত্যাখ্যান করে মুক্তিযুদ্ধের পতাকাকেই উর্ধ্বে তুলে ধরেছেন। ইতিমধ্যে জল্লাদ ইয়াহিয়া তার সাধের পাকিস্তান বাঁচাতে গিয়ে বড় বেশী দিয়ে ফেলেছে। ভারত সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ করে সে এখন ভারত আক্রমণ করে এটা পুষিয়ে নিয়ে বাংলাদেশ সমস্যাকে পাক ভারত সমস্যা হিসেবে দেখানোর অপচেষ্টায় নিয়োজিত। আর এতে তার বড় মদতগার হল বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদের মোড়ল আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র। আমেরিকা এর আগে রাষ্ট্রসংঘের সেক্রেটারী জেনারেল উথান্টের মাধ্যমে সীমান্তে জাতিসংঘ বাহিনী মোতায়েনের প্রস্তাবও অবশ্য এই উদ্দেশ্যে করেছিল বলে মনে করার যুক্তিসংগত যথেষ্ট কারণ আছে। এদিকে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতি যা বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্র ও মানবিক মূল্যবোধের প্রতি চ্যালেঞ্জস্বরুপ বিদ্যমান তা পাকিস্তান বা বাং প্রশ্নে বেশ বেকায়দায় পড়ে গিয়েছে। আমেরিকান সিনেটে ক্রমাগত বৈদেশিক সাহায্যে পরিমাণ হাসের দাবি সোচ্চার হয়ে ওঠে। ফলে ৮ই নভেম্বর সিনেটে যে বৈদেশিক সাহায্য বিলের অবলুপ্তি ঘটে তাতে আর বৈদেশিক অর্থ সাহায্যের ক্ষেত্রেও বেকায়দায় পড়ার লক্ষণ স্পষ্ট। (অবশ্য পরে এই বিলটি অনুমোদিত হয়েছে।) আন্তর্জাতিক বিশেষ করে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার রাজনৈতিক পটভূমিকায় তাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আজ তার ঐতিহ্যবাহী দুমুখো পররাষ্ট্রনীতি অব্যাহত রাখতে অসমর্থ হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ শরণার্থীদের সাহায্যদান ও বাঙ্গাল হত্যায় দস্য ইয়াহিয়া চক্রের সাহায্য কার্যক্রম যে আর পাশাপাশি চালানো যাবে না তা বিশ্বজনমত ও সংগ্রামী বাঙালীর সোচ্চার কণ্ঠ স্পষ্টভাবে বলে দিয়েছে। তার ফলেই ক্ষমতাসীর নিক্সন প্রশাসন বাংলাদেশ প্রশ্নে তাদের নিজস্ব অবস্থানকে সুদৃঢ় করতে চায়। কিন্তু তা করতে গেলে হয় মার্কিনীদের সরাসরি ইয়াহিয়ার পক্ষে নয়ত বাংলার মুক্তিকামী মানুষের পাশে এসে দাঁড়াবার প্রশ্ন ওঠে। অথচ এর কোনটাই হোয়াইট হাউস তার নিজস্ব শ্রেণী চরিত্রের কল্যাণে করতে পারে না। পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর সাথে চীনা নেতৃত্বের দহরম-মহরম, পশ্চিম ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দ্রুত পরিবর্তনশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও সর্বশেষ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের তীব্রতা বৃদ্ধি আমেরিকানদের উপরোক্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের পথে বিশেষ বাধার কাজ করেছে বলে অনুমান করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। তাই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী অশুভ শক্তি আজ বাংলাদেশ সমস্যার দ্রুত নিষ্পত্তি ঘটিয়ে এই নাজুক পরিস্থিতি হতে মুক্তি পেতে চায়। এ ব্যাপারে ইয়াহিয়ার গোপন আপোষ প্রস্তাব তাদেরকে যথেষ্ট উৎসাহিত করেছে বলে অনুমান করা যেতে পারে। তাই দীর্ঘদিন বাংলাদেশ প্রশ্নে কোন বক্তব্য না রেখে, খুনী ইয়াহিয়া চক্রের মারণাস্ত্র সরবরাহ করে আজ হঠাৎ নিক্সন প্রশাসন বাংলাদেশ সমস্যার গভীরতা পরিমাপের প্রয়োজনে এদেশে পাঠাচ্ছে বিশেষজ্ঞ দল, যাদের একমাত্র কাজ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের শত্রদের খুঁজে বের করে গোটা আন্দোলনকে আপোষের চোরাগলিতে নিক্ষেপ করে পাক-ভারত উপমহাদেশে মার্কিন অবস্থানকে অক্ষত রাখা। কিন্তু ইতিমধ্যে অনেক রক্তস্রোত বয়ে গিয়েছে পদ্মা, মেঘনা, ধলেশ্বরী, কপোতাক্ষ দিয়ে-নিক্সন প্রশাসন তা বুঝলেও হয়ত স্বীকার করতে চায় না। কিন্তু বাংলার আপামর জনগণ এই ষড়যন্ত্র ধরে ফেলেছেন। তাঁরা যা বলতে চান তা প্রতিবেশী বন্ধুরাষ্ট্রের মন্ত্রী সর্দার শরণ সিংহের মুখেই শুনে রাখুন মার্কিন বিশেষজ্ঞ দল “এ দেশে আপনাদের কোন প্রয়োজন নেই।”