পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (ষষ্ঠ খণ্ড).pdf/৬৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

31 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ ষষ্ঠ খণ্ড কিন্তু আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ বাস্তব ও যুক্তিবাদী বলে ভাবাবেগকে প্রশ্ৰয় দেন না। মূলতঃ তাঁরা নিয়মতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ রাজনীতিতে বিশ্বাসী বলে অপ্রয়োজনে রক্তপাতে আগ্রহী নন। বিনা রক্তপাতে যদি লক্ষ্যে পৌছান সম্ভব নয়, বাঙালীর আশা-আকাঙ্ক্ষা যদি রূপায়িত হওয়া সম্ভব হয়, সেই পথ অনুসরণে যাতে কোন প্রতিবন্ধকতা না আসে, তারই জন্য অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম চারটি পূর্বশর্ত দিয়েছেন। সুস্পষ্ট, দ্ব্যর্থহীন, সুনির্দিষ্ট ইঙ্গিত অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধানের কেবল দেশপ্রেমেরই পরিচায়ক নয়, এতে তাঁর মানবিকতা ও আন্তরিকতাকেও প্রতিভাত করেছে। তাঁর চারটি শর্ত বাস্তব অবস্থার প্রেক্ষিতে বাঙ্গালীর মনের কথাটিকেই প্রতিধ্বনিত করেছে। সৈয়দ নজরুল ইসলামের চারটি শর্ত হলঃ (১) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান এবং অন্যান্য রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে বিনাশর্তে মুক্তি (২) বাংলাদেশ থেকে পশ্চিম পাকিস্তানী সমস্ত সৈন্যদের অপসারণ (৩) স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের স্বীকৃতি এবং (৪) বিগত ২৩ বছরের বঞ্চিত অর্থসহ বর্তমান যুদ্ধে ক্ষতিসাধিত সম্পত্তির ক্ষতিপূরণ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলার অবিসংবাদিত নেতা। তিনি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান। তাঁকে কারাগারে রেখে কোন আলোচনা চলতে পারে না। আলোচনা চালাবার জন্য তাঁর ও তাঁর সহকর্মীদের বিনা শর্তে মুক্তি দিতেই হবে। বাংলা ও বাঙ্গালীর পক্ষে অভিমত দেবার একমাত্র অধিকারী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের বাঙ্গালীরা বিদেশী হানাদার বলে মনে করে। পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের উপর বাঙ্গালীদের কোন আস্থা নেই। তাদের উপস্থিতিতে বাঙ্গালী নিরাপদ মনে করতে পারে না এবং এ কারণেই ক্ষমা প্রদর্শনের কথা বলা সত্ত্বেও কোন উদ্বাস্তু ফিরে যাননি। ভীতি ও অবিশ্বাসের মধ্যে নিরাপত্তার ভাব জাগতে পারে না। স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার বাংলার সর্বস্তরের মানুষের আস্থাভাজন। বাংলার আশা-আকাঙ্ক্ষা স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের মাধ্যমে প্রতিফলিত। বাংলার নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত এই সরকার প্রকৃত প্রস্তাবে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করার অধিকারী। আর পশ্চিম পাকিস্তানীরা গত ২৩ বছরে বাংলাকে শোষণ করে, বঞ্চিত করে এবং সর্বশেষে গত মার্চ মাসের ২৫ তারিখ থেকে হত্যা, লুণ্ঠন ইত্যাদিতে বাংলাদেশের অর্থনীতেকে যেভাবে ধ্বংস করে দিয়েছে তার ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। নৈতিক বা আইনগত যে কোন বিচারে বাঙালী ক্ষতিপূরণ দাবী করতে পারে। বিনা অপরাধে তার সম্পদ নষ্ট করা হয়েছে। তাছাড়া বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গিতে বিচার করলে বলতে হয়, অনাহার-অনটনক্লিষ্ট, দারিদ্র-পীড়িত মানুষ কখনো শান্তিতে থাকিতে পারে না। সৈয়দ নজরুল ইসলামের চার দফার ভিত্তিতে রাজনৈতিক সমাধান হলে স্থায়ী ফল পাওয়া যাবে বলে আমরা বিশবাস করি। একটি জাতি নির্দিষ্ট এক লক্ষ্যে পৌছার জন্যে জীবন মরণ সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। রাজনৈতিক সমাধান সেই লক্ষ্যে পৌছে দিতে ব্যর্থ হলে স্থায়ী ফল বা শান্তি আসতে পারে না। সত্য সে যতই কঠোর হোক, তাকে অস্বীকার করা যায় না এবং করাও উচিত নয়। বাস্তব ও সত্যকে উপেক্ষা করার চেষ্টা করা হলেও পরিস্থিতি তার নিজস্ব গতিতে বয়ে যেতে বাধ্য। বাংলাদেশের ব্যাপারেও সত্যকে অস্বীকার করা উচিত হবে না। আজ নগ্নভাবে এ সত্যটি ভেসে উঠেছে যে বাংলা, পাঞ্জাব, সিন্ধু, বেলুচিস্তান, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ এক নয়, বাংলা ও বাঙালীর সাথে পশ্চিম পাকিস্তানের মিলনের কথাই উঠে না, এমনকি সম্প্রীতিও জাগতে পারে না। বাংলার প্রতি ঘরে যে হাহাকার উঠেছে, প্রতিটি বাঙালীর মন যেভাবে ক্ষতবিক্ষত হয়েছে, আর কোন মধুর বাণী এ হাহাকার, এ আর্তিতে প্রলেপ দিতে পারবে না। আজ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, বাংলার স্বাধীনতাই একমাত্র সমাধানের পথ। বাঙ্গালীর সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানীদের সাহিত্য, সংস্কৃতি, কৃষ্টির কোন মিল নেই এ সর্ববাদীসম্মত বক্তব্যের সাথে গত ২৩ বছরের বঞ্চনা এবং গত কয়েক মাসের হত্যা, লুন্ঠন, ব্যভিচার, নির্যাতন মিলে বাঙ্গালী-মন যেভাবে বিষাক্ত হয়ে গেছে, তাতে কোন বন্ধনের কথা প্ৰলাপ বলেই মনে হবে। তাই আজ স্বীকার করে নিতে হবে পাকিস্তান যে কোন বাস্তব বিচারে তার অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলেছে। কেবল আবেগ ও অনুভূতিতে সমস্যার বিচার চলে না।