46 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ ষষ্ঠ খণ্ড এই তাৎপর্য বুঝতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে, আজ থেকে দু’মাস আগে জানুয়ারীর এক শীত বিকেলে রমনার সবুজ ঘাসে ঢাকা রেসকোর্সের ময়দানে। তখন বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের সদ্য নির্বাচন বিজয়ের মহা উল্লাস। গণতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক অধিকার ফিরে পাওয়ার আকুল প্রত্যাশায় বাংলার আবাল বৃদ্ধা প্রায় বিশ লাখ মানুষের সামনে দাড়িয়ে অর্থাৎ গণ-আদালতে দাড়িয়ে আওয়ামী লীগের সকল সংসদ সদস্যকে শপথ গ্রহণ করতে হবে, জনগণের রায় বানচাল হতে পারে, জনগণকে দেয়া প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ হতে পারে এমন কাজ কেউ করবেন না। জনগণের সঙ্গে গণস্বার্থের সঙ্গে কেউ যদি বিশ্বাসঘাতকতা করে, তাহলে জনগণের অধিকার রইল তাকে চরম শাস্তি দেয়ার। সেদিনও বাইরের রাজনৈতিক পর্যপেক্ষকেরা প্রশ্ন তোলেননি তা নয়, নতুন করে আবার শপথ গ্রহণের দরকার কি? বাংলাদেশের জাতীয় নেতা বঙ্গবন্ধু তার ময়দানের ভাষণে এর জবাব দিয়েছেন অল্প কয়েকটি কথায়, “এই নির্বাচনী বিজয়ই চূড়ান্ত বিজয় নয়। আমাদের আবার সংগ্রামে নামতে হতে পারে।” মাত্র তিন মাসের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর ভবিষ্যদ্বানী অক্ষরে অক্ষরে ফলে গেল। ইয়াহিয়া চক্র বিশ্বাসঘাতকতা করলো। নিরস্ত্র এবং অহিংস গণ অসহযোগ আন্দোলনের মোকাবিলায় আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত কয়েক ডিভিশন রমনার মাঠ তাদের মুক্তি সংগ্রামে নেতার নির্দেশ লাভের জন্য। তাদের সকলের মনেই সেদিন একটি নীরব প্রশ্ন এরপর কি হবে? বঙ্গবন্ধু যদি তাদের মধ্যে না থাকেন, তাকে যদি গ্রেপ্তার হতে হয় বর্বর জঙ্গীচক্রের হাতে তাহলে কি হবে? কে নির্দেশ দেবে সংগ্রামী জাতিকে? এই প্রশ্নেরও জবাব দিলেন বঙ্গবন্ধু নিজেই। আবেগমণ্ডিত বজ্ৰকণ্ঠে বললেন, “আমি যদি নির্দেশ দেয়ার জন্য না থাকি তাহলে আমার এই নির্দেশ রইল, এই সংগ্রাম চলবে। এই সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এই সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।” বঙ্গবন্ধু আজ আমাদের মধ্যে হাজির নেই। হানাদার বর্বর ইয়াহিয়া চক্রের হাতে আজ তিনি বন্দী। কিন্তু বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম থামেনি, স্বাধীনতার সংগ্রাম পথভ্রষ্ট হয়নি, আওয়ামী লীগের একজন কর্মী অথবা নেতা নীতি ভ্ৰষ্ট হয়নি, বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে তারা বিশ্বাসঘাতকতা করেননি। বরং তারা আরো ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন। মুক্তি সংগ্রাম আরও জোরদার ও সংগঠিত হয়েছে। সংগ্রামে চূড়ান্ত জয়লাভের দিনও ক্রমশঃ আমাদের নিকটবর্তী হচ্ছে। আর এই সংগ্রাম ও সাফ্যল্যের নিরিখেই এ মাসে অনুষ্ঠিত মুজিবনগর বৈঠকের রাজনৈতিক তাৎপর্যও ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিচার করতে হবে। ইয়াহিয়া ভুট্টো টিক্কা চক্র আশা করেছিল, বঙ্গবন্ধকে আটক করা হলে নেতাহীন মুক্তি আন্দোলন বানচাল হবে, চরম অত্যাচারের মুখে আওয়ামী লীগ দল ভেঙ্গে যাবে, আওয়ামী লীগের পরিষদ সদস্যেরা ইয়াহিয়ার নির্দেশ মেনে নিয়ে সাড়ে সাত কোটি মানুষের নির্বাচনী রায়কে ব্যর্থ করে দেবে। এই দুরাশায় ইয়াহিয়া তথাকথিত রাজনৈতিক সমাধানের কথা বলে বিশ্ববাসীকে ধোকা দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাতে ভাবী ভোলেনি। আওয়ামী লীগ দলীয় কয়েকজন পরিষদ সদস্যকে বন্দীকরা ছাড়া আর দু’একজনের বেশী ইয়াহিয়া খান দলে ভেড়াতে পারেনি। আওয়ামী লীগ গোটা জাতির সমর্থন পেয়ে মুক্ত অঞ্চলে বাংলাদেশের গণপ্রাজতন্ত্রী সরকার গড়ে তুলেছেন, মুক্তি বাহিনীর সঙ্গে কাধে কাধে মিলিয়ে মুক্তি সংগ্রামে শরিক হয়েছেন। নগরে এই মাসের গোড়ার দিকে তারা সকলে একত্র হয়ে ইয়াহিয়ার মিথ্যা প্রচারণা ফাঁস করে দিয়েছেন এবং বিশ্ববাসীকে দেখিয়ে দিয়েছেন, শেখ মুজিব বন্দী হলেও আদর্শ রয়ে গেছে পিছনে, আর রয়ে গেছে তার ধরা দেননি। তারা সকলেই মুক্তাঞ্চলে রয়েছেন এবং মুক্তি সংগ্রামে শরিক হয়ে তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন রত। বিশ্বের কোন কোন প্রখ্যাত রাজনৈতিক ভাষ্যকার তাই বিশিত হয়ে মন্তব্য করেছেন বিশ্ব ইতিহাসে এমনটি আর কখনো ঘটেনি। আওয়ামী লীগের মত একটি নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল রাতারাতি বিপ্লবী চরিত্র গ্রহণ করবে, এটা বিস্ময়কর বিশ্বের ইতিহাসে এটা তুলনাহীন, উপমাহীন ঘটনা।
পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (ষষ্ঠ খণ্ড).pdf/৮২
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।