পাতা:বাংলাভাষা পরিচয়-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১০৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাভাষা-পরিচয়

 স্বতন্ত্র কারকের বিভক্তি যোগ করতে হয়েছে। তারই নির্দশন পাই কর্মকারকে 'তোমারে' ‘শ্রীরামেরে' প্রভৃতি শব্দে। আধুনিক বাংলা পদ্যেও এই 'রে’ বিভক্তিরই প্রাধান্য। বাংলা রামায়ণ-মহাভারতে কর্মকারকে 'কে' বিভক্তি অল্প। কবিকঙ্কণে দেখা গেছে: খাওয়াব তোমাকে হে নবাৎ আম্ররসে। অন্যত্র: উজানী নগরকে বাসিবে যেন হিম। এরকম প্রয়োগ বেশি নেই।

 বাংলা নির্বস্তুক পদার্থ-বাচক শব্দের কর্মকারকে টা টি’র প্রয়োগ-বাহুল্য, যথা 'মৃত্যুভয় দূরে করো’, ‘চক্ষলজ্জা ছাড়ো'। কিন্তু ওরই মধ্যে একটু বিশেষত্বের ঝোঁক দিয়ে বলা চলে; মৃত্যুভয়টা দূর করো, চক্ষলজ্জাটা ছাড়ো। ‘মৃত্যুভয়টাকে দূর করো’ বলতেও দোষ নেই।

 মানুষের বা জন্তু-জানোয়ারের বেলায় কর্মকারকের চিহ্ন নিয়ে শৈথিল্য করা হয় নি: গোপাল যদি সন্দেশের যোগ্য হয় তা হলে গোপালকেই সন্দেশ দেওয়া যায়। কিন্তু যে বিশেষ্যপদ সাধারণবাচক তার বেলায় কর্মকারকের চিহ্ন কাজে লাগে না, যেমন: রাখাল গোরু চরায়। ‘গোরুকে' চরায় না। ময়রা সন্দেশ বানায়, 'সন্দেশকে’ বানায় না।

 বিপদ এই একটা নিয়মের নাগাল যেই পাওয়া যায় অমনি জুটে যায় অনিয়মের দৃষ্টান্ত যথা: যে গাড়োয়ান গোরুকে পীড়ন করে সে তো কশাইয়েরই খুড়তুতো ভাই। এখানে ‘গোরু' যদিও সাধারণ বিশেষ্য তবু, এখানে কর্মকারকে ‘কে’ বিভক্তি দ্বারা তার সঙ্গে বিশেষ বিশেষ্যের মতো ব্যবহার করা হল। ঝিকে মেরে বৌকে শেখানো: এখানে ‘ঝি’ ‘বৌ’ বিশেষ বিশেষ্য নয়, সাধারণ বিশেষ্য, তবু 'কে’ বিভক্তি গ্রহণ করেছে। এটা বেআইনি বলে মনে হতে পারে, কিন্তু আইন আছে প্রচ্ছন্ন হয়ে। রাখালসাধারণ গোরু চরিয়ে থাকে, সেই তার ব্যাবসা। কিন্তু গাড়োয়ান গোরুকে যে পীড়ন করে সে একটা বিশেষ ঘটনা, না পিটোতেও পারত। বৌ-এর উপকারের জন্যে শাশুড়ি যদি ঝিকে মারে সে একটা বিশেষ ব্যাপার, মারাটা সাধারণ ঘটনা নয়।

১০১