পাতা:বাংলাভাষা পরিচয়-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১১০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাভাষা-পরিচয়

মতো ওজন ভারি করবার জন্যে। চেয়েচিন্তে কেঁদেকেটে: এরা আছে অনুপ্রাসের গাঁঠ বাঁধার কাজে। এঁটেসেঁটে খেটেখুটে খেয়েদেয়ে ঠেলেঠুলে: এরা ধ্বনির পুনরাবৃত্তিতে মনকে ঠেলে দেবার কাজ করে।

 আর-একরকম ক্রিয়াবিশেষণ আছে পদকে দুনো করে দিয়ে। যেমন, ‘জ্বর হবে হবে’ কিংবা ‘জ্বর জ্বর করছে’। মনটা ‘পালাই পালাই’ করে। এর মধ্যে খানিকটা অনিশ্চয়তা অর্থাৎ হওয়ার কাছাকাছি ভাব আছে। ‘লড়াই লড়াই খেলা’ সত্যিকার লড়াই নয় কিন্তু যেন লড়াই। ‘হতে হতে হল না’ অর্থাৎ হতে গিয়ে হল না। এতে যেমন জোর কমায়, আবার কোনো স্থলে জোর বাড়ায়: দেখতে দেখতে জল বেড়ে গেল, হাতে হাতে ফল পাওয়া। সরে সরে যাওয়া, চলে চলে ক্লান্ত, কেঁদে কেঁদে চোখ লাল, পিছু পিছু চলা, কাছে কাছে থাকা: এই দ্বিত্বে নিরন্তরতার ভাব পাওয়া যায়, কিন্তু একটানা নিরন্তরতা নয়, এর মধ্যে একটা বারংবারত্ব আছে। ‘পাতে-পাতেই মাছের মুড়ো দেওয়া হয়েছে’ বললে মনে হয় সেটা যেন একে একে পরে পরে গণনীয়। ‘পাথরটা পড়ি পড়ি করছে’, কোনো কালেই হয়তো পড়বে না, কিন্তু প্রত্যেক মুহূর্তে বারে বারে তার ভাবখানা পড়বার মতো। ‘আপনি আপনিই তিনি বকে যাচ্ছেন’ বললে কেবল যে স্বগত বকা বোঝায় তা নয়, বোঝায় পুনঃ পুনঃ বকা। এরকম ভাবব্যঞ্জনা কোনো স্পষ্টার্থক বিশেষণের দ্বারা সম্ভব নয়। এ যেন সিনেমায় ছবি নেওয়ার প্রণালীতে পুনঃ পুনঃ অনুভূতির সমষ্টি।

 ক্রিয়ার বিশেষণে অর্থহীন ধ্বনি সম্বন্ধে বাংলাশব্দতত্ত্ব বইখানিতে অনেক দৃষ্টান্ত দেখিয়েছি, যেমন: ফস্ ক’রে, চট্ ক’রে, ধপ ক’রে, ধাঁ ক’রে, সোঁ ক’রে, ঢ্যাঁচ্ ক’রে দেওয়া, গ্যাঁট্ হয়ে বসা, ঢিপ্ ক’রে প্রণাম করা। এদের কোনো শব্দই সার্থক নয় অথচ অর্থবান শব্দের চেয়ে এরা স্পষ্ট করে মনে রেখাপাত করে। ঝাঁ-ঝাঁ

১০৭