পাতা:বাংলাভাষা পরিচয়-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১২০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাভাষা-পরিচয়

তার মতো সতর্কতা দেখা যায় না। বাংলা ভাষায় নিয়মের খবরদারি যথেষ্ট পাকা নয়, কিন্তু সেও কতকগুলো নির্মাণরীতি বানিয়েছে। তার মধ্যে অনেকগুলোকে সমাসের পর্যায়ে ফেলা যায়, যেমন: চটামেজাজ নাকিসুর তোলাউন ভোলামন। এগুলো হল বিশেষ্যবিশেষণের জোড়। বিশেষণগুলোও ক্রিয়াপদকে প্রত্যয়ের শান দিয়ে বসানো। সেও একটা মিতব্যয়িতার কৌশল। বদ‍্মেজাজি ভালোমানুষি তিনমহলা, এগারোহাতি (শাড়ি): এখানে জোড়া শব্দের শেষ অংশীদারের পিঠে ইকারের আকারের ছাপ লাগিয়ে দিয়ে তাকে এক শ্রেণীর বিশেষ্য থেকে ফিরিয়ে দিয়েছে আর-এক শ্রেণীর বিশ্লেষ্যে। অবশেষে সেই বিশেষ্যের গোড়ার দিকে বিশেষণ যোগ ক’রে তাকে বিশেষত্ব দিয়েছে। অবিকৃত বিশেষ্য-বিশেষণের মিলন ঘটানো হয়েছে সহজেই; তার দৃষ্টান্ত অনাবশ্যক। বিশেষ্যের সঙ্গে বিশেষ্য গেঁথে সংস্কৃত বহুব্রীহি মধ্যপদলোপী কর্মধারয়ের মতো এক-একটা বাক্যাংশকে সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে। যেমন ‘পুঁজোবাড়ি’, অর্থাৎ পূজো হচ্ছে যে বাড়িতে সেই বাড়ি। কাঠকয়লা: কাঠ পেড়িয়ে যে কয়লা হয় সেই কয়লা। হাঁটুজল: হাঁটু পর্যন্ত গভীর যে জল সেই জল। মাটকোঠা: মাটি দিয়ে তৈরি হয়েছে যে কোঠা। দুই বিশেষণের যোগে যে সমাস তারও গ্রন্থি ছাড়িয়ে দিলে অর্থের ব্যাখ্যা বিস্তৃত হয়ে পড়ে; যেমন: কাঁচামিঠে: কাঁচা তবুও মিষ্টি। বাদশাহি-কুঁড়ে: বাদশার সমতুল্য তার কুঁড়েমি। সেয়ানা-বোকা: লোকটাকে বোকার মতো দেখায় কিন্তু আসলে সেয়ানা। বিশেষ্য এবং ক্রিয়া থেকে বিশেষণ-করা শব্দের যোগ, যেমন: পটলচেরা: অর্থাৎ পটল চিরলে যে গড়ন পাওয়া যায় সেই গড়নের। কাঠঠোকরা: কাঠে যে ঠোকর মারে। চুলচেরা: চুল চিরলে সে যত সূক্ষ্ম হয় তত সূক্ষ্ম।

 কিন্তু শব্দরচনায় বাংলা ভাষার নিজের বিশেষত্ব আছে, তার আলোচনা করা যাক।

১১৭