পাতা:বাংলাভাষা পরিচয়-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৫৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

বাংলাভাষা-পরিচয়

কে দেখেছে, কে দেখেছে, দাদা দেখেছে।
আজ দাদার ঢেলা ফেলা কাল দাদার বে।
দাদা যাবে কোন্‌খান দে, বকুলতলা দে।
বকুল ফুল কুড়োতে কুড়োতে পেয়ে গেলুম মালা।
রামধনুকে বাদ্দি বাজে সীতেনাথের খেলা।
সীতেনাথ বলে রে ভাই, চালকড়াই খাব।
চালকড়াই খেতে খেতে গলা হল কাঠ,
হেথা হোথা জল পাব চিৎপুরের মাঠ।
চিৎপুরের মাঠেতে বালি চিক্‌চিক্‌ করে,
চাঁদমুখে রোদ নেগে রক্ত ফেটে পড়ে।

 সুদূর কাল থেকে আজ পর্যন্ত এই কাব্য যারা আউড়িয়েছে এবং যারা শুনেছে তারা একটা অর্থের অতীত রস পেয়েছে; ছন্দতে ছবিতে মিলে একটা মোহ এনেছে তাদের মনের মধ্যে। সেইজন্যে অনেক নামজাদা কবিতার চেয়ে এর আয়ু বেড়ে চলেছে। এর ছন্দের চাকা ঘুরে চলেছে বহু শতাব্দীর রাস্তা পেরিয়ে।

 আদিম কালের মানুষ তার ভাষাকে ছন্দের দোল লাগিয়ে নিরর্থক নাচাতে কুণ্ঠিত হয় নি। নাচের নেশা আছে তার রক্তে। বুদ্ধি যখন তার চেতনায় একাধিপত্য করতে আরম্ভ করেছে, তখনি সে নেশা কাটিয়ে উঠে মেনেছে শব্দের সঙ্গে অর্থের একান্ত যোগ। আদিম মানুষ মন্ত্র বানিয়েছে, সে মন্ত্রের শব্দে অর্থের শাসন নেই অথবা আছে সামান্য। তার মন ছন্দে দোলায়িত ধ্বনির রহস্যে ছিল অভিভূত। তার মনে ধ্বনির এই-যে সম্মোহনপ্রভাব, দেবতার উপরে, প্রাকৃতিক শক্তির উপরেও তার ক্রিয়া সে কল্পনা করত। তাই সাঁওতাল প্রভৃতি আদিম জাতির অনেক গানের শব্দে অর্থ হয়েছে গৌণ; অর্থের যে আভাস আছে সে কেবল ধ্বনির গুণে মনের মধ্যে মোহ বিস্তার করে, অর্থাৎ কোনো স্পষ্ট বার্তার জন্যে তার আদর নয়, ব্যঞ্জনার অনির্দেশ্যেতাই তাকে প্রবলতা দেয়। মা তার ছেলেকে নাচাচ্ছে—

৫৬