পাতা:বাংলাভাষা পরিচয়-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৭৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাভাষা-পরিচয়

পড়লে পাঠকরা জানতে পারবেন বাংলা ভাষাটা ভঙ্গীওয়ালা ভাষা।

 বাংলায় এ ও উ এই তিনটে স্বরবর্ণ কেবল যে অর্থবান শব্দের বানানের কাজে লাগে তা নয়। সেই শব্দের সঙ্গে যুক্ত হয়ে কিছু ভঙ্গী তৈরি করে। ‘হরি’কে যখন ‘হরে’ বলি কিংবা ‘কালী’কে বলি ‘কেলো’, তখন, সেটা সম্মানের সম্ভাষণ বলে শোনাবে না। কিন্তু ‘হরু’ বা ‘কালু’, ‘ভুলু’ বা ‘খুকু’, এমন-কি ‘খাঁদু’ শব্দে স্নেহ বহন করে। পূর্বে দেখানো হয়েছে বাংলা ই এবং উ স্বরটা সম্মানী, এ এবং ও অন্ত্যজ। আ স্বরটা অনাদৃত, ওর ব্যবহার আছে অনাদরে, যেমন: মাখন=মাখ্না, মদন=মদ্না, বামন=বাম্‌না। ইংরেজিতে ‘রবর্ট’ থেকে ‘বর্টি’, ‘এলিজাবেথ’ থেকে ‘লিজি’, ‘মার্গারেট’ থেকে ‘ম্যাগি’, ‘উইলিয়ম’ থেকে ‘উইলি’, ‘চার্লস’, থেকে ‘চার্লি’— ইকার স্বরে দেয় আত্মীয়তার টান। ইকারে আদর প্রকাশ বাংলাতেও পাওয়া যায়। সেখানে আকারকে ঠেলে দিয়ে ই এসে বসে, যেমন: লতা=লতি, কণা=কনি, ক্ষমা=ক্ষেমি, সরলা=সর্‌লি, মীরা=মীরি। অকারান্ত শব্দেও এ দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়, যেমন: স্বর্ণ =স্বর্নি। এগুলি সব মেয়ের নাম। আই যোগেও আদরের সুর লাগে, যেমন: নিমাই নিতাই কানাই বলাই। এ কিংবা ও স্বরের অবজ্ঞা, উ স্বরের স্নেহব্যঞ্জনা সংস্কৃতে পাই নে।

 বাংলা বর্ণমালায় কতকগুলো বর্ণ আছে যারা বেকার, আর কতকগুলো আছে যারা বেগার খাটে অর্থাৎ নিজের কর্তব্য ছেড়ে অন্যের কাজে লাগে। ক বর্গের অনুনাসিক ঙ সাধু ভাষায় যুক্তবর্ণে ছাড়া অন্যত্র আপন গৌরবে স্থান পায় নি। যেখানে রসনায় তার উচ্চারণকে স্বীকার করেছে সেখানে লেখায় উপেক্ষা করেছে তার স্বরূপকে। ‘রক্তবর্ণ’ বলতে বোঝায় যে শব্দ তাকে লেখা হয়েছে ‘রাঙ্গা’, অর্থাৎ তখনকার ভদ্রলোকেরা ভুল বানান করতে রাজি ছিলেন কিন্তু ঙ’র বৈধ দাবি কিছুতে মানতে চান নি। বানান-জগতে আমিই বোধ হয় সবপ্রথমে ঙ’র প্রতি দৃষ্টি দিয়েছিলেম, সেও

৭৪