‘করলেম’। উত্তমপুরুষের ক্রিয়াপদে সানুনাসিক উকার পদ্যে এখনো চলে, যেমন: হেরিনু করিনু। কলকাতার অপভাষায় ‘করনু’‘খেনু’ ব্যবহার শোনা যায়। ক্রিয়াপদে এই সানুনাসিক উ প্রাচীন সাহিত্যে যথেষ্ট পাই: কেন গেলু কালিন্দীর কূলে, দুকুলে দিলুঁ দুখ, মলুঁ মলুঁ সই। ‘করলেম’ শব্দের আলোচনা পরে করা যাবে। কৃত্তিবাসের পুরাতন রামায়ণে দেখেছি ‘রাখিলোম প্রাণ’। তেমনি পাওয়া যায় ‘তুমি’র জায়গায় ‘তোমি’। বাংলা ভাষায় উকারে ওকারে দেনাপাওনা চলে এ তার প্রমাণ।
প্রথমপুরুষের মহলে আছে ‘সে’ আর ‘তিনি’। রামমোহন রায়ের সময়ে দেখা যায় ‘তিনি’ শব্দের সাধুভাষার প্রয়োগ ‘তেঁহ’। মেয়েদের মুখে ‘তেনার’ ‘তেনরা’ আজও শোনা যায়, ওটা ‘তেঁহ’ শব্দের কাছাকাছি। প্রাচীন রামায়ণে ‘তাঁর’। ‘তাঁহার’ শব্দ নেই বললেই হয়, তার বদলে আছে ‘তান’ ‘তাহান’। ন’কারের অনুনাসিকটা বহুবচনের রূপ। তাই সম্মানের চন্দ্রবিন্দুতিলকধারী বহুবচনরূপী ‘তেঁহ’ ও ‘তিঁহো’ (পুরাতন সাহিত্যে) হয়েছে ‘তিনি’। গৌরবে তার রূপ বহুবচনের বটে, কিন্তু ব্যবহার একবচনের। তাই পুনর্বার বহুবচনের আবশ্যকে রা বিভক্তি জড়ে ‘তাঁহা’ শব্দের রাস্তা দিয়ে ‘তাঁহারা’ শব্দ সাজানো হয়ে থাকে। সেই সঙ্গে যে ক্রিয়াপদটি তার দখলে তাতে আছে প্রাচীন ন’কারান্ত বহুবচনরূপ, যেমন ‘আছেন’। আমাদের সৌভাগ্যক্রমে পরবতী বাংলা ভাষায় ক্রিয়াপদে বহুবচনের চিহ্ন থাকলেও তার অর্থ হয়েছে লোপ। সংস্কৃতে বহুবচনে ‘পতন্তি’ শব্দ আছে প্রথমপুরুষের পতন বোঝাতে। বাংলায় সেই অন্তি’র ন রয়েছে ‘পড়েন’ শব্দে, কিন্তু এ ভাষায় ‘তিনি‘ও পড়েন ‘তাঁরা’ও, পড়েন। এই ন’কারধারী ক্রিয়াপদ কেবল ‘আপনি’ আর ‘আপনারা’, ‘তিনি’ ও ‘তাঁরা’, এঁদের সম্মান রক্ষার কাজেই নিযুক্ত। প্রাচীন রামায়ণে এইরূপ স্থানে প্রায় সর্বত্রই দেখা যায় ‘পড়েন্ত’ ‘দেখিলেন্ত’ প্রভৃতি ন্ত-বিশিষ্ট ক্রিয়াপদ একবচনে এবং বহুবচনে, প্রথমপুরুষে।