পাতা:বাংলাভাষা পরিচয়-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৯৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাভাষা-পরিচয়

পারে, সে হচ্ছে স্বরবিকারের নিয়ম। ই’র পর আ থাকলে দুইয়ে মিলে ‘এ’ হয় তার অনেক দৃষ্টান্ত মেলে। যেমন ‘ঈশান’ থেকে ‘ঈশেন’, ‘বিলাত’ থেকে ‘বিলেত’, ‘নিশান’ থেকে ‘নিশেন’।

 এক কালে ‘মুই’ ভদ্র সমাজে ত্যাজ্য ছিল না। প্রাচীন রামায়ণে পাওয়া যায় ‘মুঞি নরপতি’। কর্মকারকে ‘মোকে’, কোথাও বা ‘মোখে’। বহুবচনে ‘মোরা’। আজ ‘মোরা’ রয়ে গেছে কাব্যলোকে। কবির কলমে ‘আমরা’ শব্দের চেয়ে ‘মোরা’ শব্দের চলন বেশি প্রাচীন বাংলায় ‘আমরা তোমরা’র পরিবতে ‘আমিসব’ ‘তুমিসব’ শব্দের ব্যবহার প্রায়ই দেখা গেছে।

 আমি তুমি আপনি তিনি: ব্যক্তিবাচক সর্বনাম, মানুষ সম্বন্ধেই খাটে। ‘সে’ কেবলমাত্র মানুষ নয় জন্তু সম্বন্ধেও খাটে, যেমন: কুকুরটাকে মারতেই সে চেঁচিয়ে উঠল। ‘সে’ থেকে বিশেষণ শব্দ হয়েছে ‘সেই’। এর প্রয়োগ সর্বত্রই: সেই মানুষ, সেই গাছ, সেই গোরু। ‘এ’ থেকে হয়েছে ‘এই’। ‘এ’ বোঝায় কাছের বর্তমান পদার্থকে,‘সে’ বোঝায় অবর্তমানকে। সম্মানার্থে ‘এ’ থেকে হয়েছে ‘ইনি’।

 বাংলা ভাষার একটা বিশেষত্ব এই যে, সর্বনামে লিঙ্গভেদ নেই। ইংরেজিতে প্রথম পুরুষে he পুংলিঙ্গ, she স্ত্রীলিঙ্গ, it ক্লীবলিঙ্গ। ইংরেজিতে যদি বলতে হয়, সে পড়ে গেছে, তবে সেই প্রসঙ্গে he, she বা it বলাই চাই। বাংলায় ক্লীবলিঙ্গের নির্দেশ আছে, কিন্তু স্ত্রীলিঙ্গ পুংলিঙ্গের নেই। সে এ ও তিনি ইনি উনি: স্ত্রীও হয়, পুরুষও হয়। ক্লীবলিঙ্গে ‘সে’ ‘এ’ ‘ও’ শব্দে নির্দেশক চিহ্ন যোগ করা চাই, যেমন: সেটা ওটা সেখানা ওখানা। বাংলা কাব্যে এই প্রথমপুরুষ সর্বনামে যখন ইচ্ছাপূর্বক লিঙ্গ নির্দেশ করা হয় না তখন তার ইংরেজি তর্জমা অসম্ভব হয়। ‘যে’ সর্বনাম পদের সঙ্গে কোনো না কোনো বিশেষ্য ঊহ্য বা ব্যক্ত রূপে থাকেই। ‘যে গান গাচ্ছে’ বলতে বোঝায়, যে মানুষ। অন্যত্র: যে ঘড়ি চলছে না, যে বাড়ি ভাড়া দেওয়া হয়েছে।

৯০