পাতা:বাংলা শব্দতত্ত্ব - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১৩৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলা শব্দতত্ত্ব
১১৭

ছায়াটাকে বঙ্গভাষার অধিকার হইতে নিষ্কাশিত করিয়া দিতে পারেন’— ছায়া শব্দের এক বিশেষণ ‘বিভীষিকাময়ী’ সংস্কৃত বিধানে হইল, অন্য বিশেষণ ‘নিষ্কাশিত’ বাংলানিয়মেই হইল। ইহা হইতে দেখা যাইতেছে, সংস্কৃত শব্দ বাংলা ভাষায় সুবিধামত কখনো নিজের নিয়মে চলে, কখনো বাংলানিয়মে চলে। কিন্তু খাঁটি বাংলা কথার সে-স্বাধীনতা নাই— ‘কথাটা উপযুক্তা হইয়াছে’ এমন প্রয়োগ চলিতেও পারে, কিন্তু ‘কথাটা ঠিক হইয়াছে’ না বলিয়া যদি ‘ঠিকা হইয়াছে’ বলি, তবে তাহা সহ্য করা অন্যায় হইবে। অতএব বাংলা রচনায় সংস্কৃত শব্দ কোথায় বাংলানিয়মে, কোথায় সংস্কৃতনিয়মে চলিবে তাহা ব্যাকরণকার বাঁধিয়া দিবেন না, তাহা অলংকারশাস্ত্রের আলোচ্য। কিন্তু বাংলা শব্দ ভাষার ভূষণ নহে, ভাষার অঙ্গ— সুতরাং তাহাকে বোপদেবের সূত্রে মোচড় দিলে চলিবে না, তাহাতে সমস্ত ভাষার গায়ে ব্যথা লাগিবে। এইজন্যই, ‘ভ্রাতৃবধু একাকী আছেন’ অথবা ‘একাকিনী আছেন?’ দুইই বলিতে পারি— কিন্তু ‘আমার ভাজ একলা আছেন’ না বলিয়া ‘একলানী আছেন’ এমন প্রয়োগ প্রাণান্ত সংকটে পড়িলেও করা যায় না। অতএব, বাংলা ভাষায় সংস্কৃত শব্দ কিরূপ নিয়মে ব্যবহার করা যাইবে, তাহা লইয়া পণ্ডিতে পণ্ডিতে যত ইচ্ছা লড়াই করুন, বাংলা-বৈয়াকরণের সে যুদ্ধে রক্তপাত করিবার অবকাশ নাই।

 আমার প্রবন্ধে আমি ইংরেজি monosyllabic অর্থে ‘একমাত্রিক’ কথা ব্যবহার করিয়াছিলাম, এবং ‘দেখ্, মার্’ প্রভৃতি ধাতুকে একমাত্রিক বলিয়াছিলাম, ইহাতে প্রতিবাদী মহাশয় অত্যন্ত রাগ করিয়াছেন। তিনি বলেন:

 ব্যাকরণশাস্ত্রানুসারে হ্রস্বস্বরের একমাত্রা, দীর্ঘস্বরের দুইমাত্রা, প্লুতস্বরের তিন মাত্রা ও ব্যঞ্জনবর্ণের অর্ধমাত্রা গণনা করা হয়।

অতএব তাহাঁর মতে দেখ্ ধাতু আড়াইমাত্রিক। এই যুক্তি অনুসারে ‘একমাত্রিক’ শব্দটাকে তিনি বিদেশী বলিয়া গণ্য করেন।

 ইহাকেই বলে বিসমিল্লায় গলদ। মাত্রা ইংরেজিই কী বাংলাই কী আর সংস্কৃতই কী। যদিচ প্রাচীন ভারতবর্ষ আধুনিক ভারতের চেয়ে অনেক বিষয়ে অনেক বড়ে ছিল, তবু ‘এক’ তখনো একই ছিল এবং দুই ছিল ‘দুই’। পণ্ডিতমশায় যদি যথেষ্ট পরিমাণে ভাবিয়া দেখেন, তবে হয়তো বুঝিতে পারিবেন, গণিতশাস্ত্রের এক ইংলণ্ডেও এক, বাংলাদেশেও এক এবং ভীষ্ম-দ্রোণ