পাতা:বাংলা শব্দতত্ত্ব - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১৩৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১১৮
বাংলা শব্দতত্ত্ব

ভীমার্জুনের নিকটও তাহা একই ছিল। তবে আমরা যেখানে এক ব্যবহার করি অন্যত্র সেখানে ছুই ব্যবহার করিতে পারে। যেমন, আমরা এক হাতে খাই, ইংরেজ দুই হাতে খায়, লঙ্কেশ্বর রাবণ হয়তো দশ হাতে খাইতেন; আমরা কেবল আমাদেরই খাওয়ার নিয়মকে স্মরণ করিয়া ওই-সকল ‘বাহুহাস্তিক’ খাওয়াকে ‘ঐকহাস্তিক’ বলিয়া বর্ণনা করিতে পারি না। সংস্কৃত ভাষায় যে-শব্দ আড়াইমাত্রা কাল ধরিয়া উচ্চারিত হইত, বাংলায় সেটা যদি একমাত্রা কাল লইয়া উচ্চারিত হয় তবুও তাহাকে আড়াইমাত্রিক বলিবই— সংস্কৃত ব্যাকরণের খাতিরে বুদ্ধির প্রতি এতটা জুলুম সহ্য হয় না। পণ্ডিতমহাশয়কে যদি নামতা পড়িতে হয়, তবে সাতসাত্তে উনপঞ্চাশ কথাটা তিনি কতক্ষণ ধরিয়া উচ্চারণ করেন। বাংলা ব্যবহারে ইহার মাত্রা ছয়— সংস্কৃতমতে ষোলো। তিনি যদি পাণিনির প্রতি সম্মান রাখিবার জন্ত যোলো মাত্রায় সা-ত-সা-ত্তে-উ-ন-প-ধ্ব-শ উচ্চারণ করিতেন, তবে তাঁহার অপেক্ষা নির্বোধ ছেলে দ্রুত আওড়াইয়া দিয়া ক্লাসে তাঁহার উপরে উঠিয়া যাইত। সংস্কৃত ব্যাকরণকেই যদি মানিতে হয়, তবে কেবল মাত্রায় কেন, উচ্চারণেও মানিতে হয়। পণ্ডিতমহাশয়ের যদি লক্ষ্মীনারান বলিয়া চাকর থাকে এবং তিনি অষ্টাধ্যায়ীর মতে দীর্ঘ-হ্রস্ব-প্লুত স্বরের মাত্রা ও কণ্ঠ-তালব্য-মূর্ধন্তের নিয়ম রাখিয়া ‘লকষমীনারায়ড়’ বলিয়া ডাক পাড়েন তবে এক লক্ষ্মীনারান কেন, রাস্তার লোক সুদ্ধ আসিয়া হাজির হয়। কাজেই বাংলা ‘ক্ষ’ সংস্কৃত ক্ষ নহে এবং বাংলার মাত্রা সংস্কৃতের মাত্রা নহে, এ কথা বাংলা ব্যাকরণকার প্রচার করা কর্তব্য বোধ করেন। এইজন্ত স্বয়ং মাতা সরস্বতীও যখন বাংলা বলেন, বাঙালির ছেলেরা তাহা নিজের মাতৃভাষা বলিয়া চিনিতে পারে— তবে তাহারই বরপুত্র হইয়া পণ্ডিতমহাশয় বাংলা ভাষার বাংলানিয়মের প্রতি এত অসহিষ্ণু কেন। তিনি অত্যন্ত উদ্ধত হইয়া বলিয়াছেন যে, তিনি আরকিছুরই প্রতি দৃক্পাতমাত্র করিবেন না, কেবল ‘একমাত্রিক শব্দের দেশীয় ব্যাকরণ ও অভিধানানুযায়ী অর্থ গ্রহণ ’করিবেন। তাই করুন, আমরা বাধা দিব না। কিন্তু ইহা দেখা যাইতেছে, অর্থ জিনিসটাকে গ্রহণ করিব বলিলেই করা যায় না। অভিধান-ব্যাকরণ অর্থের লোহার সিন্ধুক— তাহারা অর্থ দিতে পারে না, বহন করিতে পারে মাত্র। চাবি লাগাইয়া সেই অর্থ লইতে হয়।