পাতা:বাংলা শব্দতত্ত্ব - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/২০১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৮২
বাংলা শব্দতত্ত্ব

 এই পদে কেবল রাধিকার গৃহের কথা হইতেছে; তিনি ক্রমে ক্রমে গৃহকার্য এবং ভােজনাদি সমাধা করিলেন এবং সন্ধ্যা হইল―কবি ইহাই দর্শন এবং বর্ণনা করিতেছেন। এখানে শ্যাম কোথায় যে তাঁহাকে সম্বােধন করিয়া বলিবেন যে, ‘হে গােবিন্দদাসের বঁধু, বেলা গেল সন্ধ্যা হল।’

 আমি কেবল নির্দেশ করিতে চাহি যে, গােবিন্দদাসের এবং দুই-একস্থলে রাধামােহন দাসের পদাবলীতে পঁহু পহুঁ বা পহু— প্রভু ও বঁধু অর্থে ব্যবহৃত হয় না। কী অর্থে হয় তাহা নিঃসংশয়ে বলা কঠিন।

 কিন্তু প্রাচীন কাব্যসংগ্রহে বিদ্যাপতির নােটে অক্ষয়বাবু একস্থলে পহু অর্থে পুনঃ লিখিয়াছেন। তাঁহার সেই অর্থ নিতান্ত অনুমানমূলক না মনে করিয়া আমরা তাহাই গ্রহণ করিয়াছি এবং দেখিয়াছি স্থানে স্থানে পহুঁ শব্দের পুনঃ অর্থ সংগত হয়। কিন্তু তথাপি স্থানে স্থানে ‘ভণে’ অর্থ না করিয়া পুনঃ অর্থ করিলে ভাব অসম্পূর্ণ থাকে; যেমন, গােবিন্দদাস পঁহু দীপ সায়াহ্ন ইত্যাদি।

 এই কারণে আমরা কিঞ্চিৎ দ্বিধায় পড়িয়া আছি। ভণহুঁ এবং পুনহুঁ এই দুই শব্দ হইতেই যদি পহুঁ-র উৎপত্তি হইয়া থাকে তবে স্থানভেদে এই দুই অর্থই স্বীকার করিয়া লওয়া যায়। কিন্তু স্মরণ রাখা কর্তব্য যে, গােবিন্দদাস (এবং কদাচিৎ রাধামােহন) ছাড়া আর-কোনাে বৈষ্ণব কবির পদাবলীতে পহুঁ শব্দ প্রয়ােগের এরূপ গােলযােগ নাই। অতএব ইহার বিরুদ্ধে যদি অন্য কোনাে দৃষ্টান্ত ও প্রমাণ না থাকে তবে অনুমান করা যাইতে পারে যে, এই শব্দ ব্যবহারে গােবিন্দদাসের বিশেষ একটু শৈথিল্য ছিল।

 প্রসঙ্গক্রমে জিজ্ঞাসা করি: আপনি মিথিলাপ্রচলিত বিদ্যাপতির পদ হইতে যে-সকল দৃষ্টান্ত উদ্‌ধৃত করিয়াছেন তাহাতে পহু শব্দে চন্দ্রবিন্দু প্রয়ােগ দেখা যাইতেছে; এই চন্দ্রবিন্দু কি আপনি কোনাে পুঁথিতে পাইয়াছেন। গ্রিয়ার্সন-প্রকাশিত গ্রন্থে কোথাও পঁহু দেখি নাই; এবং কিছুকাল পূর্বে যে হস্তলিখিত পুঁথি দেখিয়াছিলাম তাহাতে পহু ব্যতীত কুত্রাপি পহুঁ দেখি নাই।

 চৈত্র ১২৯৯